রাখাইনের মংডু এলাকায় প্রত্যাবাসনের জন্য কি ধরনের প্রস্তুতি তা দেখে ‘গো টু সি’ প্রতিনিধি দলের রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে ফিরে এসেছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২০ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে রাখাইনের মংডুতে গিয়েছিলেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেল ৬ টার দিকে টেকনাফ স্থল বন্দরের জেটি ঘাটে পৌঁছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। জেটি ঘাটে রোহিঙ্গা সদস্য আবু সুফিয়ান মাঝি ও মো. সলিম সাংবাদিকদের বলেন, তাদের কিছু দাবি দাওয়া ছিল যা মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের বলেছেন। দাবির মধ্যে অন্যতম – ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা, ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে, তাদেরকে স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ দিতে হবে ইত্যাদি।
রোহিঙ্গাদের দাবির প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের কর্মকর্তারা অনেকটা নমনীয়তা দেখিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাওয়ার পর কিছুদিন তাদেরকে অস্থায়ী ক্যাম্পে থাকতে হবে বলে মিয়ানমার কর্মকর্তারা জানান। এতে রোহিঙ্গারা সম্মতি দেয়নি বলে প্রতিনিধি দলের রোহিঙ্গা সদস্যরা জানান।
তবে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে বলে রোহিঙ্গারা মত দেন। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের প্রায় ছয় বছরের মাথায় মিয়ানমার এই প্রথমবারের মতো তাদের সংখ্যালঘু মুসলমান সমপ্রদায়ের একটি প্রতিনিধিদলকে রাখাইনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলকে সহায়তা প্রদান করতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী, অতিরিক্ত শরণার্থী কমিশনার খালিদ হোসেনসহ বাংলাদেশি ৭ জন কর্মকর্তাও সঙ্গে ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত ১৮ এপ্রিল কুনমিংয়ে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত এপ্রিলের ২৫–২৬ তারিখ প্রত্যাবাসন শুরুর পরিবেশ কতটা অনুকূল তা দেখতে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা রাখাইন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঐ সময়ে যাওয়া হয়নি। অবশেষে গতকাল শুক্রবার পরিদর্শন টিম রাখাইনে গিয়েছেন।
ওই সফরের এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানা গেছে। সব ঠিকঠাক এগোলে চলতি মে মাসে ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গার প্রথম দলটি নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় চীন ও মিয়ানমার। প্রথম দলে ৭ শতাধিক মুসলমান ও ৪ শ‘য়ের মতো হিন্দু অন্তর্ভুক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ১০ লাখ আশ্রিত রোহিঙ্গার মধ্যে ৬ বছর পর ১১ শত রোহিঙ্গা ফেরত গ্রহণ কতটুকু মানবিক তা নিয়ে অনেকে কৌতুহলী। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের পর প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও দুই দফা তারিখ চূড়ান্ত করে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। বিশেষ করে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ এবং মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবের কারণে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে রাজি করানো যায়নি।
এমন একটা সময়ে মিয়ানমার হঠাৎ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাইছে, যখন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দেশটির বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলায় পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে। ২৪ মে আইসিজেতে মিয়ানমারের বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে। বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক উম্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবদুল মুহিত রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি দ্রুত এ সমস্যার টেকসই সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে আরো আন্তরিক ও কার্যকর ভূমিকা রাখার আহবান জানান।
এ ছাড়া আগামী জুনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। ফলে চীনকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর একটি পদক্ষেপ হিসেবে মনে করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
সূত্রে জানা গেছে, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ বছর আরও ৫ ধাপে প্রতিবারে ১ হাজার ২০০ জন করে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বরের মধ্যে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ওই বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনার জন্য আগামী ডিসেম্বরে পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
তবে কুনমিংয়ের বৈঠকে ইতিপূর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের মধ্যে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৩০০ জন করে সপ্তাহের ৫ দিনে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার কথা। কিন্তু মিয়ানমার এখন বলছে, তাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় প্রতিদিন ৩০ জন করে সপ্তাহের ৫ দিনে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ চাচ্ছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে।