কবি রবীন্দ্রনাথের মতো শোককে শক্তি হিসেবে ধারণ করে- এ বন্দর নগরীতে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার মতো। এ মাসেই তার জন্ম মাস! আর এ মাসেই তিনি প্রবাসের মাটিতে বিদায় জানালেন সবাইকে-দেশের শিল্পাঙ্গনের আলোকিত এক প্রদীপ নিভে গেল চিরতরে-সময়ের বিচারে গতায়ু তিনি-তবে সৃষ্টিশীল মানুষেরা অমর হয়ে থাকেন শিল্পকর্মের মাঝে-অমরতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ান তাঁরা-তিনি ছিলেন-আছেন-থাকবেন আমাদের মাঝে অনন্তকাল-সৌরভ ছড়াবেন নীরবে-নিভৃতে-তাঁর প্রতিভা ও জীবন বাংলাদেশের অলংকার।
‘কলেজের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসে আমাদের শিক্ষক ড. মোখলেসুর রহমান সবাইকে প্রশ্ন করেন, আমরা কে কি হতে চাই? মনে আছে আমার পালা এলে আমি বলেছিলাম, ‘আমি বিবাহিত স্যার, আমার কিছু হওয়া না হওয়া আমার ওপর নির্ভর করে না স্যার।’ একথাগুলো লিখেছেন আমাদের অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট রম্য সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিন।
বিয়ে বা পরনির্ভরতা সংসার বা সন্তান তথা মাতৃত্ব কোনও কিছুই যে একজন সৃজনশীল ও অনন্য প্রতিভার মননশীল সত্তার মানুষের এগিয়ে চলার পথকে আটকে রাখতে পারে না তার এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বেগম ফাহমিদা আমিন। অফুরান প্রাণশক্তি আর তীব্র সাহিত্য তৃষ্ণা তাকে নিয়ে গেছে এক আলোর পথে যিনি আমার কাছে এক বর্ণাঢ্য আলোকস্তম্ভের মতো।
নতুন নতুন আলো ছড়িয়েছেন তিনি সাহিত্যের পাতায় পাতায় গল্প ছড়া এবং রম্যসাহিত্য-একই সাথে শিশুতোষ গ্রন্থ। তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের ভেতরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় সময়ের চাইতে এগিয়ে আছে প্রকাশ ও বিকাশ। লেখায় ও বর্ণনায় বিশ্লেষণে ও পরিবেশনায় তাঁর নিজস্ব ভঙ্গি পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে। আর এ বিশেষণ বিশেষভাবে প্রযোজ্য তাঁর রম্য রচনায়।
শাণিত বুদ্ধির খরদীপ্ততা আর সুতীক্ষ্ণ রসবোধের সংমিশ্রণে লেখা কিন্তু পাঠকের মনে আনে প্রফুল্লতা মন খুলে হাসার প্রশান্তি তেমন ধারার লেখাই রম্যরচনা। এতে কোথাও গল্পের আভাস কোথাও কাব্যের মাধুর্য কোনোখানে আবার হয়তোবা হাস্য পরিহাসের আলিম্পন নানা খণ্ডের বাহারি সমবায়ে এ এমন এক সৃষ্টি যার কোনো ধরা বাধা বা নিশ্চিত কোনো লক্ষ্য নেই প্রগলভতা ও চাপল্যের খানিক বৈঠকি চালে তা দিব্যি জমে ওঠে। রম্য রচনায় তীব্র কটাক্ষ-তীব্র রসের মাধুর্য, আবার লেখনীর মধ্য দিয়ে হাস্যরসের অবতারণা বেশ কঠিন।
আমরা জানি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক অর্থে এ ধারাটি পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট। শাণিত শব্দের কারুকার্যে সমাজ ও ব্যক্তির স্ববিরোধকে নির্মল হাসির মাধ্যমে তুলে ধরাই রম্য সাহিত্যের বিশেষ কাজ। রম্যসাহিত্যে রম্যরচনায় আধিপত্য পুরুষদের। এক্ষেত্রে সৈয়দ মুজতবা আলীসহ অনেকের নাম এসে যায়।
তবে রম্য সাহিত্যিক হিসেবে নারীদের পদচারণা খুব বেশি কি! কিন্তু অবলীলায় বলা যায় একজন ফাহমিদা আমিনের কথা। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন বটে কিন্তু রম্য রচনার সূত্রে তিনি পাঠকের সাথে যে বন্ধন গড়ে তুলেছেন সেখানে তার তুলনা শুধু তিনিই। এক্ষেত্রে তার ভেতরে যে প্রবাদ আর শ্লোকের ভাণ্ডার একেকটা রম্য রচনায় তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন।
চমৎকৃত হন পাঠক। সত্য ও সুন্দরের সাথে কঠিন বাস্তবতার এতটা মেলবন্ধন! প্রস্ফুটিত ফুলের সুবাস যেন ছড়িয়ে যায় হৃদয়ের অলিতে গলিতে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২টি এর মধ্যে নয়টিই ‘রম্যরচনা’। প্রথম গ্রন্থ ‘নিমমধু’১৯৭৪ সালে প্রকাশিত এবং শেষ গ্রন্থ সাজতে সাজতে ফিঙ্গে রাজা প্রকাশিত ২০১০ সাল। সাজতে সাজতে ফিঙ্গে রাজা’এটিও রম্যরচনা।
প্রয়াত সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর মূল্যায়নে ফাহমিদা আমিন বাংলাদেশের একমাত্র লেখিকা। তাঁর রম্যরচনা রসজ্ঞ পাঠক পাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ নিমমধু’র ভূমিকায় প্রয়াত আবু হেনা মোস্তফা কামাল লিখেছেন ‘সমকালীন জীবনের বিপুল নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যের ভেতরে দাঁড়িয়েও কেউ যে হাসতে পারছেন এবং অন্য সবাইকে হাসিতে উদ্ভাসিত করতে চাইছেন এটি কম কথা নয়’।
আর অনিবার্য কারণবশত: গ্রন্থটির পর্যালোচনায় সুচরিত চৌধুরী লিখেছেন ‘গ্রন্থটি অধ্যয়ন করতে করতে শিয়রে ছায়া জাগে পরশুরামের, শিব্রামের, আবুল মনসুর আহমেদের, সৈয়দ মুজতবা আলীর, বিভূতি মুখার্জীর, রূপদর্শীর লেখিকার সাজানো রম্য বিতানটি দেখে মনে হলো আমরা বাঙালিরা শুধু কাঁদতে জানি না, হাসতেও জানি’।
২০০১ সালে শৈলী প্রকাশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ঝালে ঝোলে অম্বলে’- এটিও রম্যরচনা। চৌদ্দটি রচনার নামকরণ – ‘না ঘরকা না ঘাটকা, তিন হাতের এক হাত অজুহাত, জোড়াতালি-নাকের বদলে নরুন, মামা-ভাগনে যেখানে, সুটকেস সমাচার, জানে-মানে গ্যাঞ্জামে, যানজটে ঝঞ্ঝাট, প্রেমের মরা জলে ডোবে না, হাঁচা কথা আর মিছা কথা, আমি যখন বাড়িওয়ালা, প্রধান অতিথির বড়ই অকাল, বিয়েতে শাদীতে, ঝালে ঝোলে অম্বলে।
নামকরণগুলো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী -যেমন তেমনি প্রবাদেও আছে। বিষয়ে এসেছে প্রবাসে বাঙালির দুর্বিষহ জীবন যাপন যেমন না ঘরকা না ঘাটকার’ শ্যাম চাচার পরদেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। একমাত্র সম্বল একটা ছেড়াখোড়া ‘বাল্যশিক্ষা’ অথবা নাকের বদলে নরুন পেলাম রচনায় ‘দেশের নামকরা কিন্ডারগার্টেন প্রিন্সিপ্যাল, জাঁদরেল ম্যাডাম হয়েছেন বেবি সিস্টার বেশি পয়সায় নিজে আয়াগিরি করেন অন্যের সন্তানের।
কাকের বাসায় কোকিলের ছা। শেষে লেখেন তিনি ‘আমাদের ছেলেরা শুধু ডিগ্রি আনতেই বিদেশ যায় না ঘোড়ার ঘাস কাটতেও যায়। নিজের নাক কেটে বাপের জন্য চকচকে নরুন নিয়ে আসে।’
সুটকেস সমাচার রচনায় বিদেশ ভ্রমণে সুটকেস যন্ত্রণার সমাধান দেন তিনি- ‘দিল্লীতে কিনেছিলাম পিঠটু। হ্যাডার স্যাক। পিঠে বেঁধে সংসার নেয়া যায়। এবার ভাবছি ভ্রমণে বেরুলে তাই একটা নিয়ে বের হব। খোয়া যাবার ভয় থাকবে না, ওজনও বাড়ানো যাবে না।
নিজেকেই বইতে হবে তো। নির্ভার ভ্রমণ, নির্ভার আনন্দ। ‘জানে-মানে গ্যাঞ্জামে’-গ্যাঞ্জাম তিন প্রকার, স্ব-সৃষ্ট গ্যাঞ্জাম, অপরে সৃষ্ট গ্যাঞ্জাম, ঘটে যাওয়া বা গেঁজে যাওয়া গ্যাঞ্জাম। জানে মানে গ্যাঞ্জামে ঘুঁটেএ ঘুঁটে-এ খানিতে খইল হয়ে যাওয়া জীবন’।
‘ওজুহাত’ বা ‘জোড়াতালি’ বা ‘হাঁচা কথা আর মিছা কথা’ এগুলো বাঙালির স্বভাব অভ্যাস এবং বলা যায় সার্বক্ষণিক শব্দসংগী। আমরা অজুহাত দেই নিজেদের দুর্বলতা এড়াতে ‘মায়ের কোল থেকেই যে ওজুহাতের লিস্টি সে মাকশো করে, সারাজীবন তাই ভেঙে ভেঙে চালায়। লেখাপড়ায় লবডঙ্ক ছাত্র বলে শিক্ষক পড়ায়না, শিক্ষক বলে ছাত্র পড়ে না। ফলাফল শূন্য।
এভাবে লেখক তার প্রতিটি রচনায় ব্যঙ্গ কৌতূহল আর হাস্যরসের মিশ্রণে অপ্রিয় সত্যগুলো তুলে ধরেন নিপুণ দক্ষতায়।
শেষ রচনা, ‘ঝালে ঝোলে অম্বলে’এর চরিত্র ‘বেরেস্তা বেগম’-লেখক নিজেই-“ইদানীং ‘স্বাধীনতা’ বেগম রোকেয়া জাতীয় কিছু পদকের মূল্যে বেরেস্তা বেগমের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আঞ্চলিক (বিভাগীয়) মনোনয়ন পেয়ে তিনি ও ডমমগ হয়ে এক দশক ধরে বায়োডাটা পাঠিয়ে চলেছেন। কেউ বলল পদক তো আজকাল নিজেই ম্যানেজ করে নিজেকেই দেয় জানেন না? বোধোদয় হয়েছে বেরেস্তা বেগমের। তবুও অনুরোধে, নির্দেশে ব্যক্তিগত বিবরণী পাঠিয়েই চলেছেন, বলাতো যায় না-যদি কোনদিন ভুল করে তাঁর নাম উঠে যায়।’
রম্যরচনার ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতায় বিভিন্ন উপমায়-কবিতার ব্যবহারে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ফাহমিদা আমিন এ অঙ্গনকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তা অতুলনীয়। তবে এ চট্টগ্রাম শহরকে ভালোবেসে এখানে অবস্থানের কারণে হয়তো তার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।
একজন ফাহমিদা আমিনের এই যে শিল্পসৃজন এবং অনুরাগ দুয়ের মূলেই আছে জন্মগত প্রবণতা। সূক্ষ দৃষ্টিতে যেভাবে তিনি সমাজের অসংগতি, অপসংস্কৃতির সাথে নানা ভাষার ব্যবহার, শ্লোক ও রূপকের মাধ্যমে হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন রম্যগ্রন্থে তা পাঠকের আনন্দ পিপাসু মনের খোরাক যুগিয়েছে- সিরিয়াস ধারার সাহিত্য কিংবা ভারিক্কি চালের উচ্চ মার্গীয় সাহিত্য আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটায়- কিন্তু মনের আনন্দ দেবার মতো রম্য রচনা কয়জন পারেন আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি আরও কঠিন। অথচ একজন ফাহমিদা আমিনের রচনায় ধার ও ভার দুইই আছে- তাঁর জীবনাচরণ, কথা কাজ সবকিছুই আমার মতো।
অনেকেই প্রেরণায় তাপিত করে- তিনি চলে গেছেন ওপারে চিরতরে তবে রেখেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জনপ্রিয়তা ছিল এ শহরে-প্রায় সভা সমিতিতে তিনি। তবে বলবো তার শক্তি ছিল লেখালেখি- যে শক্তিকে সাথে নিয়ে সংসারের নিত্য কোলাহলের সব কিছু কড়ায় গণ্ডায় শোধ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের শিখরে। এখানেই তিনি অনন্য সাধারণ ও অতুলনীয়। বেদনার সাথে বলি-একজন রত্নগর্ভা মা হিসেবে যিনি এ সমাজকে উপহার দিয়েছেন ছয়জন আলোকিত নাগরিক-শেষ বয়সে এসে হারালেন- এ স্বাধীন দেশে।
পুত্র কর্নেল এনশাদকে হত্যা করেছে বাঙালিরাই নিষ্ঠুরভাবে। কবি রবীন্দ্রনাথের মতো শোককে শক্তি হিসেবে ধারণ করে- এ বন্দর নগরীতে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের সুশীতল ছায়ার মতো।
এ মাসেই তার জন্ম মাস! আর এ মাসেই তিনি প্রবাসের মাটিতে বিদায় জানালেন সবাইকে- দেশের শিল্পাঙ্গনের আলোকিত এক প্রদীপ নিভে গেল চিরতরে-সময়ের বিচারে গতায়ু তিনি-তবে সৃষ্টিশীল মানুষেরা অমর হয়ে থাকেন শিল্পকর্মের মাঝে-অমরতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ান তাঁরা-তিনি ছিলেন-আছেন-থাকবেন আমাদের মাঝে অনন্তকাল-সৌরভ ছড়াবেন নীরবে-নিভৃতে-তাঁর প্রতিভা ও জীবন বাংলাদেশের অলংকার।
পরিশেষে বলি-রবীঠাকুরের ভাষায়-
‘বজ্রো তোমার বাজে বাঁশি, সে কি সহজ গান/ আমি ভুলব না আর সহজেতে, সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে,মৃত্যু মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ।’
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ; প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক।