বুখারী ও মুসলিম শরিফে আছে– রসূল (দ.) বলেন, ‘মানবদেহে এমন একটি মাংসের টুকরো রয়েছে যেটি পবিত্র হলে সমস্ত দেহই পবিত্র হয়, আর অপবিত্র হলে তখন সমস্ত দেহই অপবিত্র হয়ে যায়। এর নাম হৃদয় (ক্বলব)’। স্বাভাবিকভাবেই মানবাত্মা, আল্লাহর (মহাত্মা) সাথে কানেকটেড থাকে। আত্মা যখন অপবিত্র হয় তখন মহাত্মা (আল্লাহ) থেকে ডিসকানেক্টেড হয়। ‘ক্বলব’ হল আল্লাহর অবস্থানক্ষেত্র। পাপিষ্ট আত্মায় আল্লাহ অবস্থান করে না। হাদিসে কুদসিতে আছে–আল্লাহ বলেন, ‘আমার বেহেস্ত আমাকে ধারণ করে না, পৃথিবীও না, কিন্তু আমার বিশ্বাসী বান্দার অন্তর আমাকে ধারণ করে’।
ক্বলবে আল্লাহকে স্থান দেওয়ার জন্য অন্তরকে সবসময় পবিত্র রাখতে হয়। হজরত জালাল উদ্দিন রুমি (র.)বলেছেন, ‘মানুষ অর্ধেক ফেরেশতাসম, অর্ধেক পশু সম’। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতা দুটোই রয়েছে। ইতিবাচকতা স্রষ্টামুখী, নেতিবাচকতা শয়তানমুখী করে। প্রবৃত্তিতে লিপ্ত থাকলে আত্মা অপবিত্র হয়। অপবিত্র আত্মা নিয়ে আমরা যতই ইবাদত করি না কেন আল্লাহর নৈকট্যতা লাভ দুরূহ। এভাবে সারা বছর মানুষ পাপাচারে লিপ্ত থাকলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অতীব দয়ালু ও ক্ষমাশীল ; তাই তিনি চায় না বান্দাগণ রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে রসাতলে যাক। বান্দা যাতে ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হতে পারে সেজন্য তিনি বছরে এমন একটি মাস দিয়েছেন যে মাস একইসাথে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস। এর নাম রমজান মাস। যেটি অতীব মর্যাদা ও তাৎপর্যপূর্ণ বরকতময় মাস। (অন্যান্য মাসে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা কিংবা দয়া করেন না, এমনটি নয়; আল্লাহ চাইলে যখন যেকোনো মুহূর্তে, যে কাউকে যখন ইচ্ছা দয়া ও ক্ষমা করেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি আল্লাহর নিজস্ব এখতিয়ার। কিন্তু রমজান এমন একটি মাস, যে মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দাকে ক্ষমা ও দয়াবর্ষণপূর্বক মুক্তি দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের বিশেষ সুযোগ করে দেন। বলা যায় এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের মুক্তির বিশেষ সুযোগ; যাতে বান্দা রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধিসহ কলুষিত আত্মাকে পবিত্র করে মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হতে পারে। এজন্য রমজান হল আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের পূর্ণ প্রশিক্ষণের মাস। কিন্তু কীভাবে? রোজায় এমন কী ফজিলত রয়েছে, যা দ্বারা মানব পবিত্রতা অর্জন করবে? ফজিলত জানার পূর্বে রোজা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা উচিত। রোজা হল প্রতিজ্ঞা সহকারে রমজানে সুবহেসাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জৈবিক কামাচার, নেতিবাচক কর্ম ও যাবতীয় পানাহার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকার নাম। রোজা পালনে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমটি – নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উপবাস। উপবাসের ফলে মস্তিষ্কের নিউরনসমূহ অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়। এতে কর্মের গতি বৃদ্ধি পায়, চিন্তাশক্তি প্রসারিত হয়ে আধ্যাত্মিক জ্ঞানপ্রাপ্তি হয়। পাপাত্মা ধীরে ধীরে পবিত্র হয়, সর্বোপরি আত্মা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মহাত্মার সাথে মিলিত হয়। সুফিসম্রাট হজরত ইবনুল আরবী (র.)বলেন, ‘উপবাসের একটি আধ্যাত্মিক স্টেশন আছে। এর বিশেষত্ব হল নম্রতা, সমর্পণ, দাসত্ব, আত্মগৌরবের বিলোপ সাধন, প্রশান্ত আবেগ ও সকল প্রকার নিম্নচিন্তার দূরীকরণ’। উপবাস আধ্যাত্মিক জ্ঞানপ্রাপ্তিতে সহায়তা করে। হজরত আল কুশায়রি(র.) তাঁর রিশালা গ্রন্থে বলেছেন, হজরত শাল আব্দুল্লাহর মতে, ‘রোজা (উপবাস) আত্মচর্চাকারী শিক্ষানবিসদের জন্য নিয়মানুবর্তিতা, অনুশোচণাকারীদের জন্য পরীক্ষা, সংযমী সাধকদের জন্য একটি নীতি, আরিফবান্দাদের (দিব্যজ্ঞানী) জন্য এটি একটি উপহার’। রোজার দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয়টি হলো–বীর্য সংরক্ষণ সাধনা। রমজানে এক থেকে বিশ রোজা পর্যন্ত সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত (অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়) যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এরপর থেকে সাওয়াল এর চাঁদ দেখা পর্যন্ত সম্ভব হলে ইতিকাফের মাধ্যমে যৌনাচার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ রমজান মাস সিয়াম সাধনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হল রোজার মধ্যে যৌনাচার থেকে কেন বিরত থাকতে বলছেন? সহজ কথায় প্রথমদিকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বীর্য সংরক্ষণ এবং পরবর্তী ১০ দিন সম্ভব হলে এতেকাফের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে বীর্য সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছেন। রোজায় বীর্যধারণ অতীব গুরুত্ব বহন করে। বীর্য আয়নার পেছনে পারদের মত। আয়নার পেছনে পারদ না থাকলে যেমন প্রতিবিম্ব দেখা যায় না, তদ্রুপ বীর্য ধারণ করলে নিজের মধ্যে নিজেকে দেখা যায়। অর্থাৎ সর্বোপরি নিজের মধ্যে স্রষ্টা দর্শন হয়। যে বীর্য ধারণ করে তাঁর চেহারাতে নূর বিকশিত হয়। মুখমণ্ডল থেকে নূর বিচ্ছুরণ হয়। বীর্য এক প্রকার শক্তি। বীর্যশক্তিকে দেহে সংরক্ষণের মাধ্যমে উর্ধ্বমুখী করে এটিকে প্রথমে জ্ঞানশক্তি, জ্ঞানশক্তিকে আলোক শক্তিতে (নূর) পরিণত করতে হয়। এতে দেহ আত্মা, মন পরিশুদ্ধ ও পবিত্র হয়ে কামালিয়ত অর্জিত হয়। এই এবাদত সাধারণ মুসলমানের জন্য আল্লাহপাক সারা বছরের মধ্যে এক মাস করার নির্দেশনা দিয়েছেন। আর সুফিসাধকগণ বছরের অধিকাংশ সময়ই এই সাধনায় লিপ্ত থাকেন। এজন্য বীর্যসংরক্ষণ উচ্চস্তরের সাধনা। অতিরিক্ত বীর্যক্ষয়ে শরীরের রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, রোগব্যাধি বাসা বাঁধে, দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, মন চঞ্চল হয়। স্থির থাকতে পারে না। যে কামশক্তিকে জয় করতে পারে সে আল্লাহর নৈকট্যতা অর্জন করতে পারে। সেজন্য স্ত্রী সহবাস বা যৌনাচারমুক্ত হয়ে বীর্যসংরক্ষণে রমজানে আল্লাহ বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো– এমাসে এমন একটি রাত রয়েছে যে রাত হাজার বছরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এর নাম‘ শব–ই কদর‘। (এ রাতের ফজিলত– বরকত অল্প কথায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না)। (যাকে ভাগ্যরজনী বলা হয়)। যে শব –ই– কদরের রাত পেয়েছে সে আল্লাহকে পেয়েছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। রসূল(দ.) বলেন, রমজানের শেষ দশ দিন তোমরা কদর রাত তালাশ করো (বুখারী ও মুসলিম)। আর ইতিকাফের মাধ্যমে শব–ই –কদর পাওয়া সহজ হয়। শেষ দশ দিন রসূলে পাক(দ.) ইতিকাফ (নীরবে অবস্থান) করতেন, স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন, রাতে মোটেও নিদ্রা যেতেন না। সার্বিকভাবে এ মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পাপাচার থেকে বিরত থেকে আত্মশুদ্ধিকরণ সহ স্রষ্টার গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রচেষ্টার মাস। রমজান হলো –রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে প্রথম দশদিন রহমত, দ্বিতীয় দশদিন মাগফেরাত, শেষ দশদিন নাজাতের জন্য ফরিয়াদ করার মাস। সর্বোপরি রমজান মাস পানাহার, পাপাচার ও যৌনাচার থেকে বিরত থেকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে রহমতপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তির নিশ্চয়তা সহ আল্লাহর নৈকট্যতা অর্জনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাস। কিন্তু অতিব দুঃখের বিষয়– রমজানের মত বরকতময়, পবিত্র মাস পাওয়া সত্ত্বেও সিয়াম সাধনা করে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারল না, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে ব্যর্থ হল, তার মত অভাগা কেউ নেই। একদা রসূল(দ.)কে হযরত জিব্রাইল (আ.) এসে বললেন, ‘যে রমজান মাস পেল, অথচ নিজের গুনাহ মাফ করতে পারল না; সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক( তিরমিজি শরীফ)। তখন রসূলে পাক(দ.) বললেন, আমিন। আর যারা ধারাবাহিকভাবে এই মাস সিয়াম সাধনা করে আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জন করতে পেরেছেন তাঁদের জন্য সুসংবাদ। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক ইবাদতের পুরস্কার স্বয়ং আমি দিব, আর রোজার পুরস্কার আমি নিজেই। ‘অর্থাৎ স্বয়ং আমাকেই পাবে। রোজার ফজিলত এতই বেশি যে বান্দা যাতে রমজান মাসে রহমত, ক্ষমা ও মুক্তি নিশ্চিত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে, সেজন্য প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলিম নর –নারীর উপর রোজা ফরজ করেছেন। রোজা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়; তাই সুফি– আউলিয়াগণ শুধু রমজান মাসে নয়, বরং বছরের অধিকাংশ সময়েই রোজা রাখে। প্রখ্যাত সুফি হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহ্(ক.) মাইজভাণ্ডারী, হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্(ক.) মাইজভাণ্ডারী, হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক(ক.) মাইজভাণ্ডারী, হজরত মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্(ক.) ফরহাদাবাদী(প্রকাশ শাহ্সাহেব কেবলা)সহ সুফি–আউলিয়াদের জীবনী পর্যালোচনা করলে জানা যায় –তাঁরা বছরের অধিকাংশ সময়েই রোজা পালন করতেন, উপবাস করতেন, পেটে ক্ষুধা রাখতেন। শুধু উপবাস থাকলে হবে না (উপবাসের মধ্যেও কল্যাণ আছে), পাশাপাশি উপবাসের অন্তর্নিহিত হাকিকত অনুধাবণ করে ধারাবাহিক আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করতে পারলেই রোজার সার্থকতা। আল্লাহ চায় বান্দা তাঁর সাথে কানেক্টেড থাকুক। রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে সহজেই আল্লাহর সাথে সর্বদা কানেক্টেড থাকা সম্ভব। কারণ রমজান মাসে আত্মশুদ্ধির অনুশীলন, বান্দাকে সারাবছরই আত্মশুদ্ধির অনুশীলনে সহায়তা করে। এই মাসে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো সে–ই সফল। এই সফলতা তাঁকে সারাবছরই পরিশুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। এই অনুশীলন আরো সহজ হয়, যদি আল্লাহর আউলিয়াগণের সোহবতে প্রচেষ্টা চালানো যায়। কারণ আউলিয়াগণ আল্লাহর বন্ধু। এঁদের সাথে আল্লাহর সরাসরি সংযোগ থাকে। এদের সংস্পর্শে আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন অধিকতর সহজ হয়। অতএব আমাদের উচিত রমজান মাস আড্ডা–গল্প–গুজবে অতিবাহিত না করে আওলিয়াদের নেকনজরে থেকে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকা। তাই এই মাস আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জনের ধারাবাহিক অনুশীলনের মাস। আমাদের উচিত রোজাকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা। আল্লাহ পাক সকলকে সিয়াম সাধনার গুরুত্ব, বরকত এবং পবিত্রতা অর্জনসহ একমাস রোজা পালন করার তৌফিক দান করুক। আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সাজ্জাদানশীন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।