রমজানের প্রস্তুতি

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | সোমবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

আরবী ১২ মাসের মধ্যে সবচেয়ে দামী মাস হচ্ছে মাহে রমজান। আর এই রমজানের মধ্যে সবচেয়ে দামী রাত হল শবে কদরের রাত। আর এই রাতেই আসমানের নিচে এবং জমিনের উপর সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাযিল হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সহীফা রমজানের প্রথম রাতে, তাওরাত ৬ তারিখে, ইঞ্জিল ১৩ তারিখে এবং কুরআনুল কারীম ২৪ তারিখে অবতীর্ণ হয় (আহমেদ ৪/১০৭)। আল্লাহতায়ালা বলেন, কুরআনুল কারীমকে প্রথম আকাশের উপরে রামাদান মাসে কদরের রাতে অবতীর্ণ করা হয় এবং ঐ রাতকেই বারাকাতময় রাতও বলা হয়। আল্লাহতায়ালা রমজানে রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তার পবিত্র কালামে পাকে, ‘হে মানুষ তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমনি করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববতী লোকদের উপর, আশা করা যায় তোমরা (এর মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করতে পারবে)’ সূরা বাকারা১৮৩। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘রোজার মাস (এমন একটি মাস) যাতে কোরআন নাযিল হয়েছে, আর এই (কোরআন হচ্ছে) মানবজাতির জন্য পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও (হক বাতিলের) পার্থক্যকারী, অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে সে যেন এতে রোজা রাখে’সূরা বাকারা ১৮৫। সিয়াম এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পালনে খাঁটি নিয়তে পানাহার ও অন্যান্য কামনাবাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এর ফলে মানবাত্না পাপ ও কালিমা থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার ও পবিত্র হয়ে যায়। শুধুমাত্র এই হুকুম এই উম্মতের উপরেই হচ্ছে না বরং তাদের পূর্ববতী উম্মতের প্রতিও সিয়ামের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘হে যুবকবৃন্দ! তোমাদের মধ্যে যার বিয়ে করার সামর্থ্য রয়েছে সে বিয়ে করবে, আর যার সামর্থ্য নেই সে সিয়াম পালন করবেএটা তার জন্য রক্ষাকবচ হবে’– (মুসলিম ২/১০১৮)। সহীহ বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, পূর্বে আশুরার সিয়াম পালন করা হত। যখন রামাদানের সিয়াম ফরজ করা হয় তখন আশুরার সিয়াম বাধ্যতামূলক থাকে না। বরং যিনি ইচ্ছা করতেন পালন করতেন এবং যিনি চাইতেন না, পালন করতেন না। হযরত মুয়াজ (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইচ্ছা করলে কেউ সিয়াম পালন করতেন এবং কেউ পালন করতেন না। বরং মিসকিন কে খাদ্য দান করতেন। হযরত সালমা ইবনে আকওয়া (রাঃ) থেকে সহীহ বুখারীতে একটি বর্ণনা এসেছে যে, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করত সিয়াম ছেড়ে দিয়ে ফিদইয়া দিয়ে দিত। পরবর্তীতে এটা মানসুখ (রহিত) হয়ে যায়। হযরত উমর (রাঃ) উনিও এটিকে মানসুখ বলেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, এটি মানসুখ নয় বরং এর ভাবার্থ হচ্ছেবৃদ্ধ পুরুষ কিংবা বৃদ্ধা নারী যারা সিয়াম পালন করার ক্ষমতা রাখে না-(ফাতহুল বারী/২৮)। আল্লাহতায়ালা রুগ্ন ও মুসাফিরের জন্য সিয়াম ছেড়ে দেওয়ার অনুমতির কথা বর্ণনা করেন। এদের জন্য বলা হচ্ছে যে, এরা এই সময় সিয়াম পালন করবে না এবং পরে আদায় করে নিবে। অর্থ্যাৎ যে ব্যক্তির শারীরিক কোন কষ্ট রয়েছে যার ফলে তার পক্ষে সিয়াম পালন করা কষ্টকর হচ্ছে কিংবা সফরে রয়েছে সে সিয়াম ছেড়ে দিবে এবং এভাবে যে কয়টি সিয়াম ছুটে যাবে তা পরে আদায় করে নিবে। এরপরে আল্লাহতায়ালা বলেন এরূপ অবস্থায় সিয়াম ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়ে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের প্রতি বড় করুণা প্রদর্শন করেছেন এবং ইসলামের নির্দেশনাবলী সহজ করে দিয়ে তার বান্দাদেরকে কষ্ট হতে রক্ষা করেছেন। ইমাম বুখারী (রহঃ) এর একটি হাদীসে রয়েছেযে ব্যক্তি বিশ্বাস রেখে ও সৎ নিয়তে রামাদানে সিয়াম পালন করে তার পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। রাসূল (সাঃ) রামাদান মাসে মক্কা বিজয় অভিযানে সিয়াম পালন অবস্থায় রওয়ানা হন। কাদিদ নামক স্থানে পৌঁছে সিয়াম ছেড়ে দেন এবং সাহাবীগণকেও সিয়াম ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। রমজান মাসে সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর সাথে সফরে বের হতেন। তাদের কেহ কেহ সিয়াম পালন করতেন আবার কেহ কেহ সিয়াম পালন করতেন না। এমতাবস্থায় সিয়াম পালনকারীগণ যারা সিয়াম পালন করেন না তাদের উপর এবং সিয়াম না পালনকারীগণ সিয়াম পালনকারীদের উপর কোন দোষারোপ করতেন না। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছেহযরত আবু দারদা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রামাদান মাসে কঠিন গরমের দিনে আমরা রাসূল (সাঃ) এর সাথে এক সফরে ছিলাম। কঠিন গরমের কারণে আমরা মাথায় হাত রেখে রেখে চলছিলাম। আমাদের মধ্যে রাসূল (সাঃ) ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) ছাড়া আর কেহ সিয়াম পালনকারী ছিলেন না। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম ত্যাগ করে সে উত্তম কাজ করে এবং যে ত্যাগ করে না তারও কোন পাপ নেই’। অন্য একটি হাদিসে রয়েছেআল্লাহতায়ালা তোমাদের যে অবকাশ দিয়েছে তা তোমরা গ্রহণ কর। আরেকটি অভিমত হল: সিয়াম পালন করা ও না করা দু’টি সমান। তাদের দলিল হচ্ছে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসটিহযরত হামজা ইবনে আমর আসলামী (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি প্রায় সিয়াম পালন করে থাকি। সুতরাং সফরেও কি আমরা সিয়াম পালন করার অনুমতি রয়েছে? রাসূল (সাঃ) বলেন, ইচ্ছা হলে পালন কর, না হলে ছেড়ে দাও। হযরত যাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) একটি লোককে দেখেন যে, তাকে ছায়া করা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপার কি? জনগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) লোকটি সিয়াম পালনকারী, রাসূল (সাঃ) বললেন, সফরে সিয়াম পালন করা সওয়াবের কাজ নয়। যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সফর অবস্থায়ও সিয়াম ছেড়ে দেওয়া মাকরুহ মনে করে তার জন্য সিয়াম ছেড়ে দেওয়া জরুরী এবং সিয়াম পালন করা হারাম। এই রমজান মাসের মর্যাদা এত বেশি এজন্য যে, এই মাসে কোরআন নাযিল হয়েছিল বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর উপর। কুরআনুল মাজীদ বিশ্ব মানবতার জন্য মহা পথপ্রদর্শক এবং এতে প্রকাশ্য এবং উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী রয়েছে। এর মা্যধমে জ্ঞানী মানুষেরা সঠিক পথে পৌছতে পারে। এটি সত্যমিথ্যা, হারাম ও হালালের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী। এটি সুপথ ও কুপথ, ভালোমন্দের ভেতর পার্থক্য আনয়নকারী। এই কোরআন মানুষকে সত্যের পথে নিয়ে যেতে পারে আবার এই কোরআন না মানার ফলে মানুষকে জাহান্নামের কঠিন আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে। কাল কেয়ামতের কঠিন ময়দানে আল্লাহতায়ালা কোরআনের জবান খুলে দিবেন। এই কোরআন আল্লাহ প্রদত্ত চিরসংরক্ষিত আলোকবর্তিতা ও সত্যপথের দিশা। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট থেকে এক স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’। আল কোরআনের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা সূরা ওয়াক্বিয়াতে বলেন, নিশ্চয়ই এটা একটি সম্মানিত কোরআন, যা আছে সুরক্ষিত ফলকে। যারা পুত ও পবিত্র তারা ছাড়া অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। ইহা মহান প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ। এই কোরআন বিশ্ব মানবতার জন্যে সার্বজনীন ও সামগ্রিক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, ‘আমি আত্নসমপর্ণকারীদের জন্যে প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ পথনির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদ স্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করলাম’সূরা আন নাহল৮৯। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি সবকিছু বিষদভাবে বর্ণনা করেছিসূরাবনী ইসরায়েল১২। এবং এই কিতাবে কোন কিছুই আমি বাদ দিইনিসূরা আনআম৩৮। অতএব এই কোরআন মানবতার মুক্তির একমাত্র সোপান। এই কোরআন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই গুণে ধরা সমাজ থেকে দুঃশাসন, অপশাসন দূর করা সম্ভব। একটি মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর জমিনে কোরআন প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. লোকানন্দ সি ভিক্ষু স্মরণে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বঞ্চনা : প্রাসঙ্গিক কথা