রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যে অবিনশ্বর এক নাম। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই তিনি বিচরণ করেননি। বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি শিশুদের জন্য তাঁর মনোজগত ছিল অবারিত। অথচ রবীন্দ্রনাথ খুব অল্প বয়সে মাকে হারান। ১৮৫৭ সালের ১০ মার্চ তাঁর মা সারদা দেবী পরলোকগমন করেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র তেরো বছর দশ মাস। তিনি ছিলেন মায়ের ১৪ তম সন্তান। মা তাঁকে কেমন স্নেহ করতেন, আদর করতেন, তাঁর স্মৃতিমেদুর প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথের রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না। কবির জবানিতে দেখা যায়, ‘মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর।’ আসলে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িটি হচ্ছে জমিদার বাড়ি। এই বাড়ির বউদের চলাফেরায় ছিল নানা বিধিনিষেধ। সারদা দেবীকে বনেদি বাড়ির প্রতিষ্ঠিত প্রথা মেনে চলতে হতো। তবে রবির সাথে তাঁর মায়ের একটু ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই ছিল।
মায়ের স্বাভাবিক সস্নেহ প্রশ্রয় থেকে বঞ্চিত হননি রবীন্দ্রনাথ। যাত্রাপালা দেখার ইচ্ছে নিয়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া রবিকে ঠিক সময়ে জাগিয়ে দিয়েছেন মা। মাস্টার এসেছেন পড়াতে, আর তিনি পড়া ফাঁকি দিতে চান। বানিয়ে মাকে বলতেন পেট কামড়ানির কথা। তারপর, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয়নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, আচ্ছা যা মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না।’
ঠাকুরবাড়ির সব ছেলেকেই ছোট বেলায় পালোয়ানের কাছে কুস্তি শিখতে হতো। হিরা সিং নামে এক কানা পালোয়ানের কাছে কবি কুস্তি শিখেছেন। এতে গায়ে বেশ মাটি মাখামাখি হতো। কবি লিখেছেন, ‘সকাল বেলায় রোজ এত করে মাটি ঘেঁটে আসা ভালো লাগত না মায়ের, তার ভয় হতো ছেলের গায়ের রং মেটে হয়ে যায় পাছে। তার ফল হয়েছিল, ছুটির দিনে তিনি লেগে যেতেন শোধন করাতে। শোধনক্রিয়ার সামগ্রী হিসেবে থাকত বাদাম–বাটা, দুধের সর, কমলালেবুর খোসা, আরো কত কী।’
মায়ের প্রয়াণে কবিগুরু হাহাকারে আচ্ছন্ন হয়েছিলন। তবে তা চিরস্থায়ী হয়নি। মাকে স্মরণ করে কবি লিখেছেন, ‘বড়ো হইলে যখন বসন্ত প্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম। তখন সেই কোমল চিক্কন কুঁড়িগুলি ললাটের ওপর বুলাইয়া প্রতিদিন আমার মায়ের শুভ্র আঙ্গুলগুলি মনে পড়িত। আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম যে স্পর্শ সেই সুন্দর আঙ্গুলের আগায় ছিল, সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে।’
পরিণত মধ্য বয়সেও কবির মনের মাঝে মাতৃস্মৃতি পুনরায় ফিরে আসে। এর প্রমাণ মেলে, ১৯০৮ সালে শান্তিনিকেতন মন্দিরে দেয়া এক উপদেশে। সেখানে তিনি তাঁর দেখা এক স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি, আমি নিতান্ত বাল্যকালে মাতৃহীন। আমার বড় বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারের বাগান বাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন। তার আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তার ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার কী হলো জানি নে। আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন। তখনই তার ঘরে গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ! এইখানে স্বপ্ন ভেঙে গেল।’ ‘আমার মা না হয়ে তুমি/ আর কারো মা হলে/ ভাবছ তোমায় চিনতেম না/ যেতেম না ঐ কোলে/ মজা আরো হত ভারি/ দুই জায়গায় থাকত বাড়ি/ আমি থাকতেম এই গাঁেয়তে/ তুমি পরের গাঁয়ে।’ (অন্য মা)।
আসলে মা–ছেলের এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক। মাকে তো সত্যিই সেভাবে পাননি ওই বাড়ির ছেলেটিও। হয়তো মাও সেভাবে ততটা পাননি ছেলেকে। জমিদার বাড়ির নিয়ম–রীতিতে দুজনেই ছিলে আবদ্ধ। তবুও সারা জীবন সাহিত্যের আঙিনায় কত রকম মায়ের ছবি তো তৈরি করে গেলেন কবিগুরু। বীরপুরুষের শিশুর কল্পনায় মাকে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে। মা পালকিতে করে যাচ্ছিলেন। আর খোকা যাচ্ছিল মায়ের পাশ দিয়ে। মা তখন ভীষণ ভয় পাচ্ছিলেন। ডাকাতের ভয়ে মা ভেঙে পড়েছেন। ‘মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে/ তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে/ দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক’রে/ আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে/ টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে/ রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে/ রাঙা ধূলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে/ সন্ধ্যে হল, সূর্য নামে পাটে/ এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে/ ধূ ধূ করে যে দিক–পানে চাই/ কোনোখানে জনমানব নাই/ তুমি যেন আপন–মনে তাই/ ভয় পেয়েছ–ভাবছ, এলেম কোথা/ আমি বলছি, ভয় কোরো না মা গো/ ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা/ তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে/ চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে/ বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল’/ কী দুর্দশাই হত তা না হলে!’ (বীরপুরুষ)। অনুমান কিংবা ভাবনা নির্ভর হলেও মনে হয় মাকে নিয়ে তিনি বেরিয়েছেন বীরের বেশে। কবি ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় মাকে এভাবেই সাহস দিয়ে যাচ্ছিলেন। কবির ইচ্ছে হলেই মা’কে নিয়ে দেশ–বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। কখনও রাজপুত্র হয়ে আবার কখনও বীরপুরুষ হয়ে। মা খোকাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আর তাইতো কখনও না করতে পারেননি। খোকার যে কোনো ইচ্ছাই মা হাসি মুখে মেনে নিতেন। খোকা এখানেও তার ইচ্ছার কথাটি বলতে ভুল করেনি। ‘আমি যদি দুষ্টুমি ক’রে/ চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি/ ভোরের বেলা মা গো, ডালের পরে/ কচি পাতায় করি লুটোপুটি/ তবে তুমি আমার কাছে হারো/ তখন কি মা আমায় চিনতে পারো।’ (লুকোচুরি)।
বাঙালি তাদের মাতৃভাষা বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে উহ্য করায় ‘বঙ্গমাতা’ আজও প্রাসঙ্গিক। ‘পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে/ মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে/ হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে/ চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে/ দেশদেশান্তর–মাঝে যার যেথা স্থান/ খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।’ (বঙ্গমাতা)।
রবীন্দ্রনাথ মাকে বেশিদিন কাছে পাননি। জমিদার বাড়ির নিয়মের বেড়াজালে মাতৃস্নেহ খুব একটি জুটেনি। এরপরও মাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে থেকেছেন সরব। হৃদয় নিংড়ানো সব কবিতা। আরো হাজার বছর কবিগুরুর মাকে নিয়ে রচনা মানুষের অন্তরে গেঁথে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরুক থাকবেন।