রবিঠাকুরের জীবনে ‘ছুটি’

গোপা রানী দে | সোমবার , ৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পছন্দে বিয়ে করে পিতৃদেবের ও গুরুজনদের আশীর্বাদ নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলেন দাম্পত্য জীবনের ১৯ টি বছর। ৯ ডিসেম্বর ১৮৮৩ ( ২৪ অগ্রহায়ণ ১২৯০) রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। তেইশ বছরের পাত্রের সঙ্গে দশ বছরেরেও কম একটি বালিকার বিবাহ। পাত্রী খুলনার ফুলতলির ভবতারিণী, বেণীমাধব রায় ও দাক্ষায়ণী দেবীর মেয়ে। বেণীমাধব জোঁড়াসাকোর বাড়ির দপ্তরের কাজ করতেন। তারই মেয়ে ভবতারিণী হয়ে উঠেন ঠাকুরবাড়ির ছোটবউ মৃণালিনী এবং রবি ঠাকুরের প্রিয়া ‘ছুটি’। যথারীতি বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো হয়েছিল এবং ডাকযোগে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্ত কবি তাঁর বন্ধু দীনেশচন্দ্র সেন, নগেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিজের হাতে লিখা নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন। চিঠির উপর ছাপা ছিল ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের একটি পংক্তি – ‘আশার ছলে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’। রবীন্দ্রনাথ যখন দীর্ঘদেহী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, অসামান্য প্রতিভাবান সুদর্শন এক পুরুষ; মৃণালিনী তখন শীর্ণা, ক্ষুদ্রশরীরা, অল্প বয়সী এক যুবতী। বয়সে শরীরে মননে সবদিক থেকেই দুজনের ব্যবধান ছিল চোখে লাগার মতো!
রবীন্দ্রনাথ সংসার জীবনে একাধারে কর্তব্যপরায়ন স্বামী ও স্নেহশীল পিতা। তিনি হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নকে ভার দিয়েছিলেন মৃণালিনীকে সংস্কৃত শেখাবার। তাছাড়া ১৮৮৩ সালের ডিসেম্বরে জ্ঞানদানন্দিনী তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে, সেখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদেশে লোরেটোতে ঠাকুর বাড়ির ছোট বউ এর ইংরেজি শিক্ষা শুরু হয়েছিলো। ১৮৮৯ সালে রবিঠাকুরের ‘রাজা ও রানী’ নাটকে নারায়ণীর ভূমিকায় অভিনয় করে মৃণালিনী দেবী খ্যাতি লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেমন- দার্জিলিং, সোলাপুর, গাজিপুরে বসবাস করেছেন। ১৮৮৯ সালে মহর্ষি কতৃক জমিদারি পরিদর্শনের ভার পেলে কবি তাঁর পরিবার নিয়ে শিলাইদহে বসবাস শুরু করেন। রন্ধনপটিয়সী স্ত্রীর গুণমুগ্ধ ছিলেন তিনি।
মৃণালিনীই জোঁড়াসাকোর বাড়ির প্রকৃত গৃহিণী ছিলেন। বাড়ির সকলের সাথে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। সকলেই ছুটে আসতো তাঁর কাছে সুখ দুঃখের কথা বলার জন্য। ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন পাঁচ সন্তানের জননী । ১৮৮৬ থেকে ৯৪, এই সময়ের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করে বেলা, রথীন্দ্র, রাণী, মীরা ও সৌমিন্দ্র। ১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহে কাটিয়ে কবিপত্নী চলে আসেন কোলকাতার শান্তিনিকেতনে। ১৯০১ এর ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতনে স্থাপিত হয় ব্রাম্মচর্যাশ্রম। আশ্রমটির গড়ে উঠার পিছনে কবিপত্নীর অসামান্য ভূমিকা ছিল। তিনি গায়ের গহনা বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলেন আশ্রমের প্রয়োজনে। শুধু তাই নয় কায়িক শ্রম, সেবা-যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি অল্প সময়ে স্নেহময়ী আশ্রমজননী হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে লাগলেন।
মাত্র দুই কন্যার বিয়ে মৃণালিনী দেখে গিয়েছিলেন। ১৯০১ সালে দুই মেয়ে বেলা ও রাণীর বিয়ে হয় আর মৃণালিনী সংসার থেকে চিরবিদায় নেন ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর মাত্র ২৮ বছর ৮ মাস বয়সে। কনিষ্ঠ সন্তান সমীন্দ্রের বয়স তখন ৭ বছর। পত্নী বিয়োগকালে রবীঠাকুরের বয়স ছিল ৪১ বছর ৬ মাস।
মৃত্যুপথযাত্রী অসুস্থ স্ত্রীর জন্য তিনি অক্লান্ত সেবা যত্ন করেছিলেন। চিকিৎসার জন্য শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে এসেছিলেন কোলকাতায়। ছেলেমেয়েদের রেখে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। সাথে জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রকে এনেছিলেন কিন্ত পরে তাকেও পাঠিয়ে দেন শান্তিনিকেতনে। স্ত্রীর এমন অবস্থায়ও কবির ব্যস্ততার কমতি ছিলনা। তাঁর বহুমুখী হাজারো কাজ, সাথে স্ত্রীর পরিচর্যা ও সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্রম্মবিদ্যালয়ের দেখাশোনা। শেষ সময়ে রাত জেগে স্ত্রীর শিয়রে হাতপাখা করেছিলেন রাত জেগে। তবে মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর মনে অসন্তোষ ছিল কিছুটা। তিনি কনিষ্ঠ সন্তান সৌমিন্দ্রকে দেখতে চেয়েছিলেন। স্ত্রীর আকুলতা সত্ত্বেও মৃত্যুর পূর্বে শেষ বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ করে দিতে পারেননি রবিঠাকুর। শেষ দৃশ্যে মৃণালিনীর চোখের দুকোণ ছিল জলে পরিপূর্ণ, বাকরুদ্ধ ছিলেন তিনি। শুধু চেয়ে থাকতেন অসহায়ের মতো। হয়তো বা ‘ছুটি’ নাম সার্থক করে বলতে চেয়েছিলেন-এখন ছুটি হয়েছে,এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।
স্ত্রীর কাছে লিখা তাঁর কিছু চিঠির মধ্যে আমরা খুঁজে পাই তাঁর মান, অভিমান ও ভালোবাসা। ১৮৯৮ সালে পত্নীকে তিনি লিখেছিলেন -‘ভাই ছুটি মনকে খুঁতখুঁত করতে দিলেই সে আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আমাদের অধিকাংশ দুঃখই স্বেচ্ছাকৃত’। কবির মনের নিভৃত অন্দরমহলে মৃণালিনী আশ্রয় পেয়েছিলেন ‘ছুটি নামে। মৃত্যর ১ বছর আগে ১৯০১ জুন কবি চিঠিতে লিখেন -‘নির্জনতা তোমাদের পীড়া দেয় কেন তা আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার এই ভাব সম্ভোগের অংশ তোমাদের যদি দিতে পারতুম তা হলে আমি ভারি খুশি হতুম কিন্তু এ জিনিস কাউকে দান করা যায়না’।
স্ত্রীর সাথে চিঠি লিখা নিয়ে দাম্পত্য কলহ ছিল কিছুটা যা তাঁর চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে। ‘তুমি যদি হপ্তায় নিয়মিত দুখানা করে চিঠিও লিখতে তাহলেও আমি যথেষ্ট পুরস্কার জ্ঞান করতুম। এখন আমার ক্রমশ বিশ্বাস হয়ে আসছে তোমার কাছে আমার চিঠির কোনো মূল্য নেই এবং তুমি আমাকে দু ছত্র চিঠি লিখতে কিছুমাত্র কেয়ার কর না’।
অনেকসময় কাজের ব্যস্ততা, বৃহৎ সংসারের ভার, ছেলে মেয়ের দেখভাল ও সকলের নানাবিধ আবদার মিটাতে গিয়ে চিঠি লিখার সময় বের করে উঠতে পারতেন না এই কম বয়সী বালিকা বধুটি। মৃণালিনীর মৃত্যর কিছুদিন আগে এক চিঠিতে কবি লিখেন-‘যদি অনেক রাত্রে এই ছাদের জ্যোৎস্নায় তুমি বসতে তাহলে বোধ হয় তোমার মন ধীরে ধীরে বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে আসতো। আমি এখন সংসারকে এত মরীচিকার মত দেখি যে, কোন খেদের কথা মনে উঠলে পদ্মপত্রে জলের মত শীঘ্রই গড়িয়ে যায়’।
স্বামীর লিখা চিঠিগুলি মৃণালিনী দেবী সযত্নে রেখেছিলেন। তাঁর কাছে গোপনে সঞ্চিত ছিল কবির লিখা ৩৬টি চিঠি যেগুলো মৃত্যর পর উদ্ধার করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কবিকে লিখা মৃণালিনী দেবীর চিঠির একটিও পাওয়া যায়নি।
সহধর্মিণীর অকাল মৃত্যর পর রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘স্মরণ’ এর কবিতাগুচ্ছ বাংলা কাব্যে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। কবি কাকে নিয়ে শোক কবিতা লিখেছিলেন তা উল্লেখ করেননি।
তবে স্মরিত ব্যক্তি অবশ্যই একজন নারী এবং তা যে কবিপত্নী তা এই বিরহগাথার প্রতিটি চরণে প্রকাশ পায়। উল্লেখিত কিছু পংক্তি –
‘তোমার সংসার মাঝে, হায় তোমাহীন
এখনো আসিবে কত সুদিন-দুর্দিন
তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস টানে
তোমারে খুঁজিতে এসে চাব কার পানে’?
‘শেষ কথা’ কবিতায় কবির একাকীত্ব জীবনের কষ্ট উঠে এসেছে। ১৩০৯ সালে বঙ্গদর্শনে মুদ্রিত ‘পূজা’ কবিতায় লিখেছিলেন-
‘আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে-
রাখিব জ্বালি আলো।
তুমিতো ভালোবেসেছ, আজি একাকী শুধু আমারে বাসিতে হবে ভালো’।
ভবতারিণী থেকে মৃণালিনী, ছোট বউ থেকে রবিঠাকুরের ‘ছুটি’ লোকান্তরিত হওয়ার পর কবির অন্তরের প্রিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

তথ্যসূত্র : অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের ‘কবি ও কবিপত্নী ‘/
দেশ পত্রিকা:৭০ বর্ষ ১৩ সংখ্যা /উইকিপিডিয়া
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএলো রমজান
পরবর্তী নিবন্ধসর্বোত্তম আমল আল্লাহতা’আলা ও প্রিয় নবীজির (সা.) প্রতি মহব্বত