১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের রাজনীতির এক কালো অধ্যায়। ’৭৫ এর এই দিনে আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হারাইনি, হারিয়েছি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ শব্দটি সৃষ্টি করেছিলেন সেই স্বাধীনতার অনুপ্রেরণাকে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। জীবন যৌবনের ২৪ বছর আন্দোলন সংগ্রামের ১৩ বছর কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। তিন বার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও অধিকারহারা মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য থেকে পিছপা হননি। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চাপের মুখে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে সাহস করেনি। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন- কোনো বাঙালি আমাকে হত্যা করবে না। জাতি কি পেরেছিল সকল রাজনীতির উর্ধ্বে ওঠে এই দেশপ্রেমিক ও বাঙালি প্রেমিক মানুষটিকে জাতির অবিসংবাধিত নেতা হিসেবে সত্যিকারের সম্মান দিতে? পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে একটি কবর দেখিয়ে বলা হয়েছিল- তুমি কি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাও? নাকি এই কবরে যেতে চাও? তিনি সেই দিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন ফাঁসির পরে আমার লাশটি তোমরা আমার বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দিও। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্রেস্টো বলেছিলেন আমি হিমালয় দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে বার বার সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বলেছিলেন, যদি জানতাম এই ট্যাংক, গোলা বারুদ বঙ্গবন্ধুর প্রাণ কেড়ে নিবে তাহলে কোনোদিন এগুলো দিতাম না।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল ডিবিসি-তে রাজকাহন নামে একটি অনুষ্ঠানে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে টক-শোতে তিন জন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। লে: কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম, মেজর (অব.) নাছির উদ্দিন উপস্থিত থাকলেও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফি উল্লাহ উপস্থিত হন নি। কিছুদিন আগে একই চ্যানেলে অন্য একটি টকশো-তে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, জেনারেল শফি উল্লাহ ছিলেন একজন অপদার্থ। ১৫ আগস্ট হামলার সময় বঙ্গবন্ধু জেনারেল শফি উল্লাহকে ফোন করলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে সেখান থেকে কোনো রকম পালিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রী সভায় আওয়ামী লীগের বিশ জন নেতা শপথ গ্রহণ করেছিলেন। তৎমধ্যে ফনী ভূষণ মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে ধরে এনে জোর করে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেকে বলে থাকেন, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে কোনো আন্দোলন সংগ্রাম হয়নি। আমি এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করছি। জিয়ার এলাকা থেকে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। সেই সময় বগুড়া যুবলীগের সভাপতি খালেকুজ্জামান খসরুকে গ্রেপ্তারের পর বিনা বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর কৃতী সন্তান গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মৌলভী সৈয়দ প্রতিরোধ আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ’৭৭ এর জুলাই মাস পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ মাসের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে ২০৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিসিয়ারী জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের আবেদনে বঙ্গবন্ধু শব্দটি বাদ দিয়ে একই বছর ৪ নভেম্বর দলের নিবন্ধন অনুমোদন দেওয়া হয়। ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে কারাভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে দেশের মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা আরো বেশি ভীত সন্তস্ত্র হয়ে পড়ে। এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের জন্য আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে দেওয়া হয়নি। এ যেন এক মগের মুল্লুক। বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করেন। অথচ তার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সনদপত্র বা তার বিয়ের কাবিননামায় কোথাও ১৫ আগস্ট জন্ম তারিখটি উল্লেখ নেই। এটি রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত একটি ঘৃণ্য কুরুচিসম্পন্ন কাজ বৈ আর কিছু নয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বিএনপি এই কাজটি করে। দীর্ঘ ২১ বছর আন্দোলন সংগ্রামের পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো ১৯৯৬ সালের ১২ জুন। ৭ম জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁর রক্তের উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। নির্বাচনী ইশতিহারে দেওয়া যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ইতিহাসের এই জঘন্যতম ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের উত্থান ও বাঙালির অবিসংবাধিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে হবে। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
এই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার রাজনীতিবিদরা, যারা পাকিস্তানী ভাবধারায় বা পাকিস্তানপন্থী ছিলেন তারা প্রকাশ্যে শত্রুতাবশত গুজবের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন ঘটনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে উত্থাল করে তুলল পূর্ব বাংলা। গুজবের কারণে যুদ্ধের পূর্বে ও যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানীর শোষণ, জুলুম, নির্যাতন, পৈশাসিক কর্মকাণ্ড আরও নির্মম হয়ে উঠল। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় আসীনে সমাসিন হলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে ঢেলে সাজানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রসংশিত হতে লাগল। ’৭৩ সালে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে ঈদের জামাতে দুই জন সংসদ সদস্যকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হল। পাটের গুদামে আগুন দিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করল। বঙ্গবন্ধু সংসদে দাঁড়িয়ে এই নৈরাজ্য ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠিন হুঁিশয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, পাকিস্তানী ভাবধারায় যারা দেশকে নিতে চায়, আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করতে চায়, তাদের ক্ষমা করা হবে না। শান্তিপূর্ণ পথ সেদিন কারো জন্য খোলা ছিল না।
ষড়যন্ত্রকারীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত এবং তাদের সর্বশেষ পরিণতিও আমরা ইতিহাসে খুঁজে পাই। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল কাদের এমপি বলেন, দলে কাওয়্যা ঢুকেছে। এদের বিতাড়িত করতে হবে। নেত্রীর নির্দেশ- নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। জীবনে যারা একদিনের জন্যও জয় বাংলার শ্লোগান দেয়নি তারা আজকে বড় নেতা সেজেছে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে সেটা হতে পারতো না। দলের দুর্দিনের নেতাকর্মীদের খবর কেউ নেয় না। অর্থের অভাবে অনেক নেতাকর্মী সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ নব্য আওয়ামী লীগ ও হাইব্রিডরা রাতারাতি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন আজ তারই কন্যার নেতৃত্বে এক যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছেন।
আর দলের লীগ শব্দটি ব্যবহার করে নানা নাম সর্বস্ব সংগঠন গড়ে অনেকেই ধান্ধাবাজিতে লিপ্ত হয়েছেন। এই ধান্ধাবাজদের আইনের আওতায় এনে দলীয় সংবিধান অনুসারে অঙ্গ সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্ধারিত করে এদের ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লব অর্থনৈতিক মুক্তি, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে তাঁর কন্যা চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই। রক্তাক্ত আগস্ট আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও মর্যাদাকে নিদারুণভাবে কলঙ্কিত করেছে। এর বিপরীতে বর্তমান দেশের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার হাতকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে নিহত বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ