বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষের মধ্যে বিবাহ প্রথা চালু আছে। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ বা গোত্রের বিবাহ প্রথার মধ্যে পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বিবাহ হচ্ছে জীবনের একটি ধ্রুব সত্য। জন্ম, মৃত্যু বিয়ে এই তিনটিকে বলা হয় জীবনের অপরিহার্য ঘটনা। এই বিয়ের ফলেই সামাজিক বন্ধনের বিস্তৃতি ঘটে এবং এর মাধ্যমেই সমাজ ও সভ্যতা বিকশিত হয়। আমাদের বাঙালিদের মধ্যে বিবাহ অনেকের কাছে সুখকর একটি ঘটনা এবং বিয়ে পরবর্তী সময়ে নানা পরিবর্তন ঘটে জীবনে। আবার অনেকের জীবনে বিয়ে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেয়। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে আমাদের সকলের প্রত্যাশা থাকে বিয়ে যেনো সকলের জীবনে অনাবিল সুখ- শান্তি ডেকে আনে। বিয়ে পরবর্তী নানা অপ্রীতিকর ঘটনার অনেকগুলো কারণ আছে। সে অনেকগুলো কারণের মধ্যে যৌতুকপ্রথা অন্যতম প্রধান একটি কারণ। এ কারণে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কতো নারীকে যে জীবন দিতে হয়েছে, কতো নারী নির্যাতিত হয়েছেন কিংবা স্বামী কর্তৃক তালাকের শিকার হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান করা দুরূহ। তবুও আমরা বলতে পারি এ সমাজ ব্যবস্থায় যৌতুকপ্রথা একটি নিষ্ঠুর বাস্তবতা। যৌতুক বিরোধী নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচির পরও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজে যৌতুকপ্রথা চালু আছে এবং এটিকে রোধ করা যায় নি। বলা হয় যৌতুকপ্রথা হচ্ছে একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নিয়ে বরপক্ষ ও কনে পক্ষের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ লেগে থাকে। কেউ প্রকাশ্যে যৌতুক দাবি করে বিয়ে করেন, আবার অনেকে কনে পক্ষ না বললেও সামাজিকতা বা বর কনেকে সাজিয়ে দেবার যুক্তিতে প্রকান্তরে যৌতুকই দিয়ে থাকেন। অনেকে প্রকাশ্য না বললেও কৌশলে আকার ইঙ্গিতে যৌতুক চান। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের গ্রামীণ সমাজে যৌতুক এখনো বাস্তবতা। শিক্ষিত সমাজ ব্যবস্থায় যৌতুকের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে সত্য। বিয়েতে এই যৌতুকের পাশাপাশি উপহার দেবারও একটি সংস্কৃতিও প্রচলিত আছে। ব্যাপারটিকে আমরা হয়তো কেউ তেমন গুরুত্ব দিই না বা নিছক হালকাভাবে দেখার চেষ্টা করি। কেউ কেউ এটাকে সৌজন্যবোধের প্রকাশ হিসাবেও দেখেন। কিন্তু এর একটি নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে তা হয়তো আমরা কেউ তেমন করে উপলব্ধি করি না। বিয়ের কারণে এক ধরনের সামাজিক ব্যস্ততার সৃষ্টি হয়। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে বৌ-ভাত পর্যন্ত দাওয়াতের বিষয় থাকে বিয়েকে উপলক্ষ করে। সেই বিয়ের দাওয়াতে কতটা আলাদাভাবে উপহার দেয়া যায় সেই চিন্তাও থাকে অতিথিদের মনকে ঘিরে ধরে। তৈরি হয় নানা ধরনের পরিকল্পনা। উপহার হিসাবে বিছানার চাদর, ডিনার সেট,ওয়াল ম্যাট, অ্যান্টিক টেবিল ল্যাম্প, বর আর কনের একসঙ্গে তোলা ছবি মগ, চা কিংবা কফি সেট, নন স্টিকের হাঁড়িপাতিলের সেট, ইস্ত্রি, টোস্টার, রাইস কুকারসহ অ্যান্টিক শোপিস, বড় ছবির ফ্রেম, দেয়াল ঘড়ি ইত্যাদি জিনিস পছন্দের হিড়িক পড়ে যায়। অনেকে প্রাইজ বন্ড অথবা নগদ অর্থও দিয়ে থাকেন। বিয়েতে দাওয়াতপ্রাপ্ত আত্মীয় পরিজন বা বন্ধুবান্ধবরাই এই উপহার নিয়ে থাকেন। উপহার দেয়াটা যেনো অপরিহার্য একটি বিষয়। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে খেয়াল করলে দেখবেন দাওয়াতপ্রাপ্ত আত্মীয় স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশিদের মধ্যে সবাই আর্থিকভাবে সচ্ছল নন। এই উপহার দেয়াটা নিয়ে অনেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। অনেকেই যাদের সামর্থ্য আছে তারা উপহার নিয়ে যান ঘটা করে, নিজেকে এক ধরনের আভিজাত্য শ্রেণির বিবেচনা করেন, অনেকে মুখ রক্ষার্থে উপহার নিয়ে যান, আবার অনেকেই উপহার দেয়ার দায় দায়িত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দাওয়াত পেয়েও কৌশলে বিয়ে এড়িয়ে চলেন। ব্যাপারটা ঘটে মানুষের মধ্যে আর্থিক সচ্ছলতার ভিন্নতার কারণে। যদিও এটি বাধ্যতামূলক নয়। বিয়েতে উপহার কোন মুখ্য বিষয় হতে পারে না। এখানে দম্পতির সুখ প্রত্যাশা করাই সকলের কাম্য। বিয়ে করা বরকনে পক্ষের মধ্যে সবাই আর্থিকভাবে সচ্ছল নাও হতে পারেন। ব্যাপারটির মর্মার্থ উপলব্ধি করে উভয়পক্ষ অত্যন্ত সচেতনভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেন। সামান্য একটি বিষয়কে বড় মনে করে বিয়ের দাওয়াত এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়। অথচ সচেতনভাবে খেয়াল করলে দেখবেন কোন না কোনভাবে এ ঘটনাগুলো ঘটছে আড়ালে। যদিও কেউ এটা নিয়ে ভাবেন, কেউ এটা নিয়ে ভাবেন না। কেউ বুঝলেও বলতে চান না। বিয়েতে উপহার তুচ্ছ একটি বিষয়। বিয়েতে উপস্থিতির জন্য সকলের সমান মর্যাদা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বরকনে উভয় পক্ষেরই। কেউ যদি আন্তরিকতার সঙ্গে তার বিয়েতে দাওয়াত করেন সে ব্যক্তি কোন প্রকার হীনমন্যতাবোধে না ভোগে, যাতে ঐ বিয়েতে উপস্থিত হতে পারেন তা নিশ্চিত করার জন্য সকলের সমান পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। তাহলে দেখবেন পরিবেশটাই হবে অন্যরকম ভালোলাগার। কারণ একজন মানুষও যদি উপহার বিষয়টা এড়িয়ে যেতে বিয়েতে উপস্থিত হবার বিষয়টি এড়িয়ে যান তা সকলের জন্য দুঃখজনক। বিয়ের মত সামাজিক একটি অনুষ্ঠানে উপহার, যৌতুক কোনটিই কাম্য নয়। বরং এগুলো এড়িয়ে চলতে পারাটাই বড় মনের পরিচয়।
রুচিশীল মানুষরাই সামাজিক এধরনের পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারেন। বিয়ের কার্ডে অনেকে শুধুই দোয়া বা আশীর্বাদই কাম্য লিখে দায় সারেন অনেকেই। কিন্তু তা মানেন না। তার প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই অহরহ। বরকনে উভয় পক্ষ অনুষ্ঠানের আগে দৃঢ়ভাবে দাওয়াতকৃতদের উপহারের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হলে ধীরে ধীরে তা সর্বজনীন সামাজিক রীতিতে পরিণত হতে পারে। এরকম অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানের সাথেও পরিচয় হয়েছে। চমৎকার ভালোলাগার একটি বিষয়। এই ইতিবাচকগুলো এভাবে উপহার, যৌতুকের মত বিষয়ে যার যার মত করে নিয়ে আসলে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো হয়ে উঠতে পারে সকলের সকল আনন্দ ভাগাভাগির মিলন কেন্দ্র।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।