বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য শহরে ছ’বছরের কিছু বেশী সময় কাটিয়ে চোখের জল নাকের জল এক করে অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ; রঙিন আলখেল্লা গায়ে চাপিয়ে, ঝালর দেয়া টুপি মাথায় দিয়ে ছবি তোলার দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বললেন- এ তোমার একান্ত সম্পদ, যা কোনদিন কেউ তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। চারচারটি বছর আগের কথা। আজও সেদিনটার কথা মনে হলে বুকের কাঁপন টের পাই। সনদলাভের আগেই দেশে ফিরে আসার টিকিট কেনা হয়ে যায়। ভ্রমণ পরিকল্পনা সংস্থার (ট্র্যাভেল এজেন্ট) কর্মীর অবাক জিজ্ঞাসা- ‘ওয়ান ওয়ে টিকেট’? ফেরত টিকেট করছেন না কেন? আমাদের সহজ উত্তর- ফিরবোনা তাই। কর্মী মানুষটি কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত; এই তল্লাটের যে কেউ বিদেশ ভ্রমণের সময় রিটার্ন টিকেট হাতে নিয়েই যাত্রা করে। তাকে বুঝিয়ে বলা হয়- থাকব বলেতো আসিনি এই তল্লাটে। কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ। এবার ঘরের ছেলের ঘরের ফেরার পালা।
মেলবোর্ন থেকে ঢাকাগামী টিকেট তিনটি সযত্নে ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়ি এতগুলো বছর ধরে বানানো বন্ধুদের শেষ বিদায় জানাতে। প্রতিদিন দু’তিন বাড়ি যাই; ফাঁকে ফাঁকে বাক্স গোছানো চলে। কোথাও আবার কয়েক পরিবার মিলে আয়োজন করে বিদায় সম্বর্ধনা। কিন্তু বিস্ময় কাটেনা অনেকের। ওখানে থিতু হওয়া দেশী ভাইবোনেরা, একই সঙ্গে সাদা চামড়ার অযি (অস্ট্রেলিয়ান) বন্ধুরা ভেবে পায়না আমরা কেন ফিরে যাচ্ছি। স্থানীয় বাসিন্দারা নিকট অতীতে কাউকে ফিরে যেতে দেখেনি। এতোকাল ধরে ওরা দেখে এসেছে একবার কেউ ওদের মাটিতে পা দিতে পারলে ফেরার নামটি করেনা। ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে আমার বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ধারণা খুবই নেতিবাচক, নিম্নমানের। আমাদের মতো দুর্দশা কবলিত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে পেরে তারা বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করে। যদিও সরকারী-বেসরকারি দপ্তরে, মুদি দোকানে, বাসে-ট্রামে রেলে ভিড় হলে সাদাসাদা মুখগুলো ধূসর হয়ে যায়, কপাল কুঁচকে যায়, মুখ ফুটে কিছু বলা হয় না। আর যাই হোক আইনের চোখে সবাই সমান এই নীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব পালন করে যায় তারা। সভ্য জাতির সঙ্গে আমাদের তফাৎ ঠিক এখানটায়।
তবে তাদের অনেকের সাথে প্রকৃতই বন্ধুত্ব হয়। দোনমনো করে কেউ কেউ প্রশ্নটা করেই ফেলে- তোমার দেশ কী নিরাপদ? খাবার দাবারের সংকট হবে না তো…? আশ্বস্ত করি ওদেরকে- আমার রাষ্ট্র স্বাধীন ও সার্বভৌম। স্বতন্ত্র মানচিত্র ও পতাকা লাভের অর্ধ শত বছর পূর্ণ করতে চলেছে। আমাদের আছে হাজার বছরের গৌরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তোমাদের মতো ধনী না হলেও আমার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি লেখাপড়ার যাবতীয় ব্যয়ভার কিন্তু আমার রাষ্ট্রই বহন করেছে। উন্নত প্রশিক্ষণের জন্যই এই দূরদেশে আসা। দেশমাতাকে আমি কথা দিয়ে এসেছি- কাজ শেষে আসব ফিরে। সাদা চামড়ার বন্ধুরা চমৎকৃত, টুপি খোলা অভিবাদন জ্ঞাপন করে। উপহারে ঘর ভরে যায়। চোখের জলে শেষ হয় বিদায়ী সম্ভাষণ।
স্বদেশী ভাই-বোনদের মাঝে বেশ অনেকে বাহাবা জানান। বুকের ভেতর জমানো হাহাকার তাঁদের চোখেমুখে ভেসে ওঠে। তবে অনেকেই আমাদের এমন অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তাঁদের মাঝে দু’দশক ধরে বসবাসকারী বাংলাদেশী যেমন আছেন, তেমনি আছেন মাত্র কয়েকমাস আগে গিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করেছেন, এমন অনেকেও। মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁদের মন্তব্য ও ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন ঘটে তাঁদের প্রতিটি বাক্যে। সন্দেহ নেই তারা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী; আমাদের ভাল’র জন্যই হয়তো আমাদেরকে প্রবাসে থিতু হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের ভাষাপ্রয়োগে মাতৃভূমির প্রতি মমত্ববোধের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি, যাকে কেবল বেদনাদায়ক বললে কমিয়ে বলা হবে।
– দেশটা পঁচে গেছে, ঐ দেশে মানুষ থাকে? আইনকানুন বলে কিছু নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই, চিকিৎসা নেই। খাবারে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, বাতাসে বিষাক্ত সীসা। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, আর চাটুকারে ভরে গেছে দেশটা, সবাই রাজনীতি করে, রাজনীতির নামে নোংরামি চলে যত্রতত্র। দেশে যে ফিরে যাবে, কাজ করতে পারবে? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা আছে নাকি? মারামারি, খুনোখুনি এইতো করে বেড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা। এদের মানুষ করবে? বাঁচতে পারলে তো। শিক্ষকদের কথাও বলিহারি- লজ্জা লজ্জা! এত রঙ বেরঙের শিক্ষক পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কী! আরও অনেক অনেক কথা- ভয়ের কথা, আশংকার কথা। এসব কথার এক বর্ণও মিছে নয়, সবই সত্য, চরম সত্য। সাবধানবাণী শুনে শুনে ধন্দে পড়ে যেতে হয়।
নীরবে শুনে যাই সব। বুকের ভেতর ক্রমাগত বেজে চলে- ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা..’, ‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ…’। মনে মনে বলি- মানুষ হতে হবে না আমার ছেলেমেয়েদের। মানুষ হলে যে ওরাও পালাবে দেশটা ছেড়ে। মুখ ফুটে বলতে পারি না- আপনিতো বড় মানুষ হলেন। দেশ আপনাকে এত কিছু দিল। দেশকে আপনি কী দিলেন? কবিগুরুর সেই কথাগুলো মনে পড়ে –
অনেক তোমার খেয়েছি গো অনেক নিয়েছি মা,
তবু জানিনে যে কী-ই বা তোমায় দিয়েছি মা
আমার জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা
বাক্স গোছানো শেষ হয়ে আসে। সাতবছরের হাঁড়িকুঁড়ি, থালাবাসন, বিছানাবালিশ, চেয়ার টেবিল, একে-তাকে বিলিয়ে দিয়ে, আর শেষ বেলায় কেনা গাড়িটা বেচে দিয়ে দেশের বিমানে উঠে পড়ি। কিন্তু দেশেও ফিরেও সেই একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে; কেন ফিরে এলে? কর্মক্ষেত্রে, বন্ধুমহলে, আত্মীয়আসরে আমাদের বোকামোর জন্য ঠাট্টা করেন অনেকে। সবাই যখন পা বাড়িয়ে পালাবার জন্য, তখন আমাদের ফিরে আসাটায় অবাক না হয়ে পারেন না তারা। তবে কেউ কেউ স্বাগতও জানান।
প্রিয় পাঠক, অভিবাসী বা অভিবাসী হতে ইচ্ছুক বাংলা মায়ের দক্ষ জনগোষ্ঠীর বিষোদ্গার করা এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। অভিবাসনের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। বাধ্য হয়ে কিংবা স্বেচ্ছায় অভিবাসনের ধারা জগতজুড়ে চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। কোটি কোটি মানুষের কপাল খুলে যায়, ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় অভিবাসনের হাত ধরে। কোন যাদুমন্ত্রবলে নয়, হাঁড়ভাঙা খাটাখাটুনির বদৌলতে। অভিবাসী হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখা যায় না। আমি অবশ্য দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে, অভিবাসী গবেষক হিসেবে। অনেকেরই না গিয়ে উপায় ছিল না; কর্মক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক হেনস্তার শিকার হয়ে এক বুক জ্বালা নিয়েই স্বদেশভূমি ত্যাগ করেছিলেন তাঁরা। আরও নানাবিধ কারণ ছিল অভিবাসনের পেছনে। কিন্তু, ঐ যে বললাম জন্মভূমিকে কটাক্ষ করার কথা- বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশ থেকে আগত অভিবাসীদেরকে এমনি করে নিজ দেশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে দেখিনি। বড় বিষাদ ভরা মন নিয়ে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল, দেশের মাটিতে দেশের দান ও আশীর্বাদে পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাওয়া মানুষগুলো নিরাপদ ও উন্নত জীবনের আশায় দেশত্যাগ করে, উন্নত পৃথিবীতে ঠাঁই করে নেওয়ার পর অবলীলায় দেশটার সাপ সাপান্ত করে যান বড় আসরে গলা উঁচিয়ে। সুদান, ইথিওপিয়া, সোমালিয়ার মতো দেশের আভিবাসীরা প্রাণ হাতে পালিয়ে এসেছে মাতৃভূমি ছেড়ে। তারাতো এমনি করে নিজের দেশকে গাল দেয় না।
পশ্চিমে থিতু হওয়া অনেক বাংলাদেশী অভিবাসী বলেই ফেলেন- ‘বাংলাদেশের নিউজ ফলো করি না, নিতে পারি না- টু ভাল্গার, টু ক্রুড…’। কথাগুলো চরম সত্য হলেও এভাবে বলা কথাগুলো আমিও যেন মেনে নিতে পারি না। একটা পরিবারে যখন কোন সংকট বা দুঃসময় আসে তখন কী পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা নিজ নিজ লোটাকম্বল নিয়ে পালিয়ে বাঁচে? না কী সবাই মিলে একটা সমাধানের পথ খোঁজে? পরিবারের সুদিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে? আমার পরিবারে সংকটকালে আমি যদি পালিয়ে বাঁচি, পরিবার কিন্তু বাঁচে না। অন্য কোন অশুভ শক্তি এসে তাকে কব্জা করে নেয়। খোলনলচে পাল্টে ফেলে ঘরবাড়ি সবকিছুর। মুছে ফেলে সকল ঐতিহ্যের স্মারক, গৌরবের স্মৃতিচিহ্ন। দেশের বেলাতেও কী একই কথা চলে না? বিশেষত দেশটা যখন অনেক দাম দিয়ে কেনা।
আমার এই বায়বীয় আবেগঘন রচনায় প্রবাস জীবনের নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য ফেলে দেশের বিমানে উঠে পড়বেন, কিংবা প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্নে কেউ রাশ টেনে ধরবেন সেই প্রত্যাশা করি না। তবে যেখানেই যান অভাগা দেশটার সাপ সাপান্ত করবেন না- এইটুকুই মিনতি করি।