যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি

ইসরায়েলে ৪০টিরও বেশি ড্রোন দিয়ে ইরানের হামলা উত্তেজনার মধ্যে গুয়ামে যাচ্ছে মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ২২ জুন, ২০২৫ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে এখনও কোনো পক্ষ নমনীয়তার আভাস দেয়নি। ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সংঘাত শুরু হওয়ার পর গতকাল ৯ দিন অতিবাহিত হয়েছে। গত ১৩ জুন ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ইরানে কমপক্ষে ৪৩০ জন নিহত এবং তিন হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েল জানিয়েছে যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে ২৫ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে একজন হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। আর আহত হয়েছেন দুই হাজার ৫১৭ জন।

সর্বশেষ ইসরায়েলে ৪০টিরও বেশি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে ইরান। গতকাল শনিবার সকালে একটি ড্রোন উত্তরাঞ্চলীয় বেইট শেআন শহরের একটি ভবনে আঘাত হানে আর আরেকটি দক্ষিণাঞ্চলে একটি মহাসড়কের কাছে খোলা জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটায়। দেশটির জরুরি পরিষেবা মেগান ডেভিড আদম এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েলের উত্তরপূর্বাঞ্চলে জর্ডানের সীমান্তের কাছে বেইট শেআন উপত্যকায় আঘাত হানা ড্রোনে ওই ভবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবে কেউ হতাহত হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার ফটো সাংবাদিক জানিয়েছেন, ভবনটির পাশে ড্রোনের বিস্ফোরকের ধাক্কায় সৃষ্ট বিশাল একটি গর্ত দেখা গেছে আর সেখান থেকে প্রচুর মাটি চারপাশে ছিটকে পড়েছে। ওই গর্তের পাশে ভবনটির দেয়াল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

এ যুদ্ধে এখনও কোনো পক্ষ নমনীয়তার আভাস দেয়নি। ফলে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

আর দীর্ঘায়িত হলে শক্তিতে কে কোথায় এগিয়ে থাকবে, সেই প্রশ্নে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল প্রযুক্তিতে এগিয়ে। তাদের অর্থনীতিও মজবুত। তবে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে সেই মজবুত অর্থনীতিও নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে ইরানের শক্তির জায়গা হিসেবে বিশ্লেষকরা দেশটির ‘ক্ষতি সইবার’ ক্ষমতাকে সামনে আনছেন। তারা বলছেন, ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পর থেকে গত চার দশক ইরানের মানুষ যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। ফলে যুদ্ধ নিয়ে তাদের ‘প্রস্তুতিটা আলাদা’। দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক মুহান্নাদ সেলুম বলেন, ‘এই যুদ্ধে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বটা ইসরায়েলের। তবে ইরানের অন্যান্য বহু শক্তি রয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল ইরানের আকাশপথ পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা বলছে। তবে মনে রাখতে হবে, আয়তনের দিক থেকে ইসরায়েলের চেয়ে ইরান ৭০ গুণ বড়। ইরানের মানুষ অনেক ক্ষয়ক্ষতি সইতে পারেন। আবার এমন অস্ত্রও তাদের রয়েছে, যা ইসরায়েলে আঘাত হানতে সক্ষম।

এদিকে যুদ্ধ নিয়ে তীব্র উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বেশ কয়েকটি বিটু স্টিলথ বোমারু বিমান প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ গুয়ামে নিয়ে যাচ্ছে। গতকাল দুই মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে এ বিষয়টি জানিয়েছেন।

ইসরায়েলের সঙ্গী হয়ে ইরানে সরাসরি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেবে কি না সে বিষয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার মধ্যেই এসব অত্যাধুনিক বোমারু বিমান মিজৌরির হোয়াইটম্যান বিমান ঘাঁটি থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়ামে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সামরিক ঘাঁটির উদ্দেশে রওনা হয়েছে।

ডানার বিস্তারে ৫০ মিটারের বেশি প্রশস্ত এই বিশাল বিমানগুলোই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ১৩৬০০ কিলোগ্রামেরও বেশি ওজনের বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমা জিবিইউ৫৭ বহন করতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের পর্বতের গভীরে অবস্থিত ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করতে প্রয়োজন এই রকম অন্তত দু’টি বোমা। ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এই বোমা ব্যবহার করা হতে পারে।

আকাশপথে ইসরায়েলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকলেও পর্বতের ১০০ মিটার গভীরে অত্যন্ত সুরক্ষিত কংক্রিটের বাংকারে অবস্থিত ফোরদো পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করার মতো কোনো অস্ত্র দেশটির নেই। এই কেন্দ্রটি ধ্বংস করতে হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রয়োজন হবে। তবে গুয়ামে বিটু বোমারু বিমান মোতায়েনের এই পদক্ষেপের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, রয়টার্স তা নিশ্চিত হতে পারেনি। সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মার্কিন সেনাবাহিনী ইরানে হামলা চালালে লোহিত সাগরে ভাসমান আমেরিকান জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার ঘোষণা দিয়েছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা।

এর আগে মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, আমরা জানি না কীভাবে তাদের (আমেরিকানদের) বিশ্বাস করবো। তারা যা করেছে, তা আসলে কূটনীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ইরান কখনোই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে রাজি হবে না, এবং ইসরায়েলকে অবশ্যই আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে, তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না।

এনবিসি’র পক্ষ থেকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, দুই সপ্তাহের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধান সম্ভব কিনা। তখন আরাগচি বলেন, ‘এটা নির্ভর করছে আমেরিকানদের ওপর। তারা কি আদৌ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী, নাকি তাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে এবং তারা কি ইরানে হামলা করতে চায়?’ তিনি আরো বলেন, ‘তাদের হয়তো এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে এবং তারা হয়তো ওই পরিকল্পনা ঢাকতে আলোচনার নাটক করছে।’

এদিকে জেনেভায় ইরানের সঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির পরমাণু বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। তেহরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, সমঝোতা নয়, আলোচনায় রাজি তারা। ইউরোপের দাবি ছিল, পরমাণু অস্ত্র বিসর্জন দিতেই হবে ইরানকে। ইরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, ইসরায়েল হামলা না বন্ধ করলে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবে না তারা। ঘটনাচক্রে, সেই পরমাণু বৈঠক ‘ব্যর্থ’ হতেই গতকাল আরও আগ্রাসী হল ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের আরও এক পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি। এই নিয়ে ১০ জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছে ইরানে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে গৃহবধূকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ
পরবর্তী নিবন্ধউচ্ছেদ ঠেকাতে বিষপানে মহিলার আত্মহত্যার চেষ্টা