এই লেখাটা ইউক্রেনে বাংলাদেশী জাহাজে মিসাইলের আঘাতে নিহত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদীসুর রহমানের উদ্দ্যেশ্যে উৎসর্গ করলাম। আমি ফিরে এসেছি, সে তো ফিরে নাই।
লাইফ-জ্যাকেট পড়ে ইমার্জেন্সির জন্য আমরা সকলে মিলে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি। জাহাজে সবসময়ই ইমার্জেন্সি-ড্রিল হয়। আগুন লাগলে কী করতে হবে, জাহাজ ডুবতে থাকলে কী করতে হবে, লাইফবোট চালানো, কাউকে মেডিক্যাল ফার্স্ট-এইড দেওয়া ইত্যাদি নানান বিষয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয়। শুধু বইতে পড়া থাকলেই চলবে না, বা কোর্স করে সার্টিফিকেট থাকলেও চলবে না। সবসময়ই হাতেনাতে প্র্যাক্টিক্যালি আমরা ড্রিল করে থাকি। সপ্তাহে একটা দুইটা ড্রিল হয়ই। কিন্তু আজকেরটা কোনো ইমার্জেন্সি-ড্রিল না, এখন আমরা সত্যিকারের ইমার্জেন্সির জন্য প্রস্তুত। এমনকী খোলা ডেকে দাঁড়ানোটাও বিপদজনক, সেইজন্য সকলেই একটু আড়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সকলেরই মুখ গম্ভীর আর ফ্যাকাশে, যেকোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। আমাদের সকলেরই এখন জীবন-মরণ অবস্থা। আমি মনে মনে আল্লাহ্কে স্মরণ করছি, দোওয়া-দরুদ যা মনে আসছে পড়ে চলেছি।
বাহারাইন থেকে রওনা দিয়েছিলাম দুপুরের দিকে, এখন সূর্যাস্তের একটু আগে হঠাৎ করে এলার্ম; এবং পাবলিক সিস্টেমে ক্যাপ্টেনের নির্দেশু সকলে ইমার্জেন্সি স্টেশানে গিয়ে প্রস্তুত থাকো। লাইফ-জ্যাকেট পরেই আমার নির্ধারিত স্টেশানে দৌড়ে গেলাম। বাহারাইন বলেছি যখন, ম্যাপ দেখলেই বুঝতে পারবেন আমরা পারস্য উপসাগরে রয়েছি। ১৯৮৮ সাল ইরান-ইরাক যুদ্ধ পুরোদমে চলছে। তার মাঝে আমরা উলুখাগড়ার মতো জান নিয়ে আটকে পড়েছি।
দুইদেশের মাঝে যুদ্ধে তাদের সৈনিক মারা যায়; সেইসাথে হয়তো অনেক অনেক নিরীহ বেসামরিক সাধারণ মানুষও মরে সেটাই যুদ্ধকালীন স্বাভাবিক। মাঝেমধ্যে অন্যদেশের মানুষও মরতে পারে যুদ্ধকালীন ভুলের কারণে, বা কেউ যদি যুদ্ধরত কোন দেশের পক্ষ নিয়ে লড়াই করে (mercenary), অথবা সাংবাদিক বা জাতিসংঘের পরিদর্শক। এরকম অনেকজনকেই আমরা চিন্তা করতে পারি যুদ্ধের শিকার হিসাবে। কিন্তু আমরা যারা মার্চেন্ট মেরিনার (নেভী নই), সাধারণ কার্গো জাহাজে কাজ করি, তারাও কিন্তু কখনো ভুলবশতঃ, আবার কখনো যুদ্ধরত কোনো পক্ষের ইচ্ছাকৃত কারণে যুদ্ধে মারা যাই।
আমি ১৯৮৭/৮৮ সালে মিস্ট্রাল নামের এক রীফার (রেফ্রিজেরেটেড কার্গো) জাহাজে কাজ করতাম। ব্রাজিল থেকে কলা, চিকেন-মাটন-বিফ নিয়ে মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলোতে যেতাম। আমরা ব্রাজিলের বন্দর প্যারানাগুয়া থেকে পূর্বদিকে রওনা দিয়ে আড়াআড়িভাবে দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উত্তামাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) দিয়ে ঘুরে, মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিকের মাঝের মোজাম্বিক-চ্যানেল পার হয়ে একটু তেরছাভাবে উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে চালিয়ে ওমান চলে আসতাম। তারপরে হরমুজ প্রণালী পার হয়ে পারস্য উপসাগরে যেয়ে, সেখানের অনেকগুলো পোর্টে কার্গো ডিসচার্জ করতাম।
ইরান-ইরাক যুদ্ধ ১৯৮০ সালে শুরু হয়ে, বছরের পর বছর চলে; তারপরে ‘৮৭/’৮৮-র দিকে তুঙ্গে উঠে। দুই পক্ষই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মাঝে ১৯৮৮-তে যুদ্ধ শেষ করে, কোনোপক্ষই কিন্তু জয়ী হয় না। প্রত্যক্ষ স্থলযুদ্ধ চলতে চলতে, তারা পরোক্ষ জলযুদ্ধও শুরু করেছিলো। ম্যাপে দেখবেন পারস্য উপসাগরের পূর্বপাশের পুরাটাই ইরানের; ইরাক একদম উপরের দিকে অল্প একটু ছুঁয়ে আছে মাত্র। উপসাগরের পশ্চিমপাশে অন্যান্য গালফ-রাষ্ট্রগুলো (কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, আরব-আমীরাত)। ইরাক তখন অ্যামেরিকার দোস্ত; তাই ঠিক করলো দুই একটা ইরানি জাহাজ (বিশেষ করে তেলের ট্যাঙ্কার) ডুবিয়ে দিলে, তাতে করে ইরান যদি বেপরোয়া হয়ে সবধরনের জাহাজ আক্রমণ করে, তখন ইরাক তার বন্ধু অ্যামেরিকার প্রত্যক্ষ সামরিক সাহায্য আরো বেশী পাবে। অ্যামেরিকাই হয়তো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। বিশেষ করে ইরাক চাইছিলো যে ইরান যদি উপসাগরে ঢোকার সরুমুখ, ‘হরমুজ প্রণালী’ বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্ব-জনমত ইরানের বিপক্ষে যাবে কারণ সেটা বিশ্বের একটা স্ট্র্যাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। সেই ইরাকী কুবুদ্ধি থেকেই শুরু হলো তেলের ট্যাঙ্কার আক্রমণ। তারপরে যেকোনো সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজও তাদের টার্গেট হয়ে দাঁড়ালো। স্থলভাগের কামান-মিসাইল, প্লেন থেকে বোমা সবকিছু দিয়েই যত্রতত্র আক্রমণ শুরু হলো। ইরানও উল্টা প্রতিশোধ নিতে ছাড়লো না। তারাও আক্রমণ করলো। এছাড়াও তাদের যেহেতু উপসাগরের কূলবর্তী সীমানা বেশী, তাই তারা শুরু করলো ছোট ছোট স্পীডবোট দিয়ে আক্রমণ, ডুবন্ত ম্যাগনেটিক-মাইন বসানো ইত্যাদি ইত্যাদি। হুট-হাট স্পিডবোটে করে এসে, জাহাজ লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গোলাগুলি ছোঁড়া, বা ইচ্ছা করেই গোঁত্তা লাগানো, ইত্যাদি নানান রকমের হ্যারাসমেন্ট করতো তারা। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিলো ম্যাগনেটিক মাইন, মিসাইল, গোলা, কামান, ফাইটার-জেট ইত্যাদি। এবং তারা একে অন্যের জাহাজ তো এটাক করতো না, ইরাকের বলতে গেলে কোন জাহাজই ছিলো না। ইরানই জলপথে একচ্ছত্র অধিপতি। কিন্তু তারা অন্যদেশীয় জাহাজ এটাক করতো, অজুহাত দিতো সেই জাহাজে তাদের শত্রুপক্ষের মালামাল আছে; অথবা কখনো কোনো অজুহাতই ছিলো না। নেহাৎ মেরে দিয়ে চলে গেলো।
এর ফলে সব মালবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারগুলো স্ব-স্ব দেশের নেভীর সাহায্যে চলাফেরা শুরু করলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র Operational Earnest Will এবং Operation Prime Chance নামে জাহাজকে এস্কর্ট করতো। তবে তাদের চাহিদা ছিলো, জাহাজকে অ্যামেরিকায় রেজিস্ট্রি করে অ্যামেরিকান ফ্ল্যাগের আওতায় থাকতে হবে। সেইরকম ভাবে ইংল্যান্ড করলো Armilla Patrol ও Operation KIPION নামে। আমাদের জাহাজটার মালিকানা Cayzer Irvine বা CI Shipping Line নামের একটা বৃটিশ কোম্পানীর, কিন্তু সেটা পানামাতে রেজিস্টার করা। দ্রূত জাহাজের রেজিস্ট্রেশান পানামা থেকে বদলে বাহামাতে করে নিলো। বাহামাকে বৃটিশ টেরিটোরি হিসাবে গণ্য হয়। সুতরাং আমরাও বৃটিশ নেভীর এস্কর্ট পেতাম। আমরা ব্রাজিল থেকে এসে, আরব সাগরে ওমানের কাছে নোঙর করে অপেক্ষা করতাম। এরকম দশ-বারোটা জাহাজ একত্রিত হলে, বৃটিশ নেভীর অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ আমাদেরকে লাইন করে ফ্লোটিলার মত এস্কর্ট করে নিয়ে যেত। উপর দিয়ে তিন-চারটা হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে চারিদিকে খেয়াল রাখতো। যার ফলে, কোন পক্ষ থেকেই আমাদের আক্রমণ করতে পারতো না। শুধু একটাই ভয় থাকতো পানির তলার মাইনের। যতটুকু সম্ভব বুঝেশুনে চালাতে হতো। নেভীর জাহাজ আমাদেরকে প্রথম পোর্টে পৌঁছে দিয়ে চলে যেতো, পরের কাফেলা আনার জন্য। তারপর থেকে আমরা নিজেরাই এক পোর্ট থেকে অন্য পোর্টে যেতাম কারণ এগুলো সবই ছিলো পশ্চিমপাশে একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া। তবে আবার যখন আমরা হরমুজ প্রণালী পার হয়ে বের হয়ে যাবো, তখন আবার একটা বহির্গামী কাফেলার জন্য অপেক্ষা করে, একসঙ্গে কয়েকটা জাহাজ মিলে বৃটিশ-নেভীর এস্কর্টে বের হয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম।
আজ সকালে বাহরাইনে পোর্টে আমাদের জাহাজের সামনে একটা বেশ বড়সড় ট্যাঙ্কার ছিলো। এখন দেখছি আমাদের চোখের সামনে সেই ট্যাঙ্কারটাই আগুনে পুড়ছে। মনে হয় মাইন বা বোমার আঘাতে জাহাজটা ধ্বংস হয়েছে। জাহাজের নাবিকেরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, তাদেরকে সাহায্যের জন্য চারিদিক থেকে অ্যামেরিকান আর বৃটিশ নেভীর বোট ছুটে আসছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে ট্যাঙ্কারে, অনেকগুলো ফায়ারবোট থেকে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা চলছে। টাগবোট দড়ি লাগিয়ে জ্বলন্ত জাহাজটাকে সাইডে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত, যাতে করে সেই জাহাজ জ্বলে-পড়ে ডুবে গিয়ে সকলের চলাচলের রাস্তা না আটকে দেয়। সেই ট্যাঙ্কার বাহরাইনে পোর্ট ছাড়ার তিন ঘন্টা পরে আমরাও রওনা দিই এবং এখন বের হয়েই তাদের দুরবস্থা দেখছি। তারা প্রথমে বের না হয়ে, যদি আমরা বের হতাম, তাহলে? তাহলে হয়তো আজকে এখানে বসে আমি এই লিখাটা লিখতে পারতাম না।
জাতিসংঘের হিসাব মতে সেই ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাড়ে পাঁচশ’র মত জাহাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো আর ৪৩০ জন নিরীহ মেরিনার মারা গিয়েছিলো। আমিও হয়তো হতে পারতাম ৪৩১ নাম্বার ভিক্টিম। অথবা আমাদের জাহাজেরই কেউ বা পুরা জাহাজের সবাই। আল্লাহ্ হায়াৎ দিয়েছিলেন বলে এখনো বেঁচে আছি। বেশ কয়েক ঘন্টা ইমার্জেন্সি এলার্টেও উপরে থেকে, পরে সব নরমাল হলো অল ক্লিয়ার। আমরা সেই দফা নিরাপদে, সুস্থ অবস্থায় বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। আল্লাহ্কে অনেক শুকরিয়া। আমার একটা অনুরোধ কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতূহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২
জাতিসংঘের হিসাব মতে সেই ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাড়ে পাঁচশ’র মত জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো আর ৪৩০ জন নিরীহ মেরিনার মারা গিয়েছিলো। আমিও হয়তো হতে পারতাম ৪৩১ নাম্বার ভিক্টিম। অথবা আমাদের জাহাজেরই কেউ বা পুরা জাহাজের সবাই।