বলা যায়, পৃথিবী এখন অশান্ত। এই সৌরমণ্ডলের পৃথিবী নামক গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে ভয়াবহ যুদ্ধ। এক দেশের সাথে আর এক দেশের। এক জাতির সাথে আর এক জাতির। এক গোষ্ঠির সাথে অপর এক গোষ্ঠির। সবচেয়ে ভয়াবহ আকারে রূপ নিয়েছে ফিলিস্তিন–ইসরাইল যুদ্ধ ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের তুলনায় অমানবিক যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে ফিলিস্তিন–ইসরাইল যুদ্ধ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হঠাৎ করে ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়। তাছাড়া জিম্মি করে গাজায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে। এরপরেই শুরু হয়ে যায়, ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হামাস কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাল্টা হামলার কথা জানালেও প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনের বিপুল এলাকা ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। একই সাথে বিপুল পরিমাণ নারী–শিশু এবং পুরুষ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। এই অমানবিক অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও বিশ্বের মুরুব্বি দেশগুলো প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ বন্ধের জন্য এগিয়ে আসেনি। এক দিকে লোক দেখানো যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা আর অপরদিকে ইসরায়েলকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক সাহায্য দেয়ার প্রবণতা বিশ্ব বিবেককে দারুণভাবে তাড়া করে। কিন্তু বিশ্ব বিবেকের আকুল মিনতিকে মুরুব্বি দেশগুলো মোটেই পাত্তা দেয়নি। ফলে চলেছে এক নিষ্ঠুর নিদারুণ খেলা। বিশ্ব বিবেকও বুঝে যায়। ফলে এ পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দারা ছিল নিশ্চল, নিশ্চুপ। তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর নিঃশব্দে নীরবে মাথা নিচু করে রেখেছে। ক্ষেত্র বিশেষে চোখের জল ফেলেছে। তাদের কিছুই করার ছিল না।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হয় গাজায় এক তরফা যুদ্ধ। শুরু হয় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ। এরপর থেকে যুদ্ধবিরতির বহু চেষ্টা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবুও যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় চলছিল সমঝোতার প্রচেষ্টা। এরই মধ্যে ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে কাতারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দোহায় আলোচনার পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন হামাস ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা। এরপর ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দেয় ইসরায়েল সরকার। যুদ্ধবিরতি যে কার্যকর হতে যাচ্ছে, তার চূড়ান্ত নিশ্চয়তা পাওয়া যায় তখনই। গাজায় যুদ্ধ শুরু থেকে ইসরায়েলকে একক সমর্থন ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও এই যুদ্ধবিরতির পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান ছিল বেশি। চুক্তি অনুযায়ী, গাজায় এই যুদ্ধবিরতি হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহে ৩৩ জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি পাবে ইসরায়েলের কারাগার থেকে। গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো হবে এবং ইসরায়েলি সেনাদের একাংশকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি শুরু হবে। অবশ্য এরমধ্যে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আরো অনেক ঘটনা ঘটে যায়, যা ইসরায়েল ও হামাস এর মধ্যে পরস্পর অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধবিরতিরে ঘোষণা আসার আগেই ইসরায়েল অভিযোগ করে যে, হামাস চুক্তির কিছু অংশ থেকে সরে এসেছে। ফলে ইসরায়েল চুক্তি অনুমোদন স্থগিত করে। তবে এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে হামাস। এরপর এক ঘোষণা আসে যে, যুদ্ধবিরতিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। এরপরও গাজায় হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছিল ইসরায়েলি বাহিনী। ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে মধ্যস্থতাকারীরা কাতার ঘোষণা দেন যে, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময়ের বিষয়ে ইসরায়েল ও হামাস সম্মত হয়েছে। তাছাড়া তাদের ঘোষণা অনুসারে ১৯ জানুয়ারি থেকে এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। ১৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের মন্ত্রীসভায় চুক্তিটি অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হামাস শেষ মুহূর্তে চুক্তির অংশ থেকে সরে এসেছে– এমন অভিযোগ তুলে মন্ত্রীসভার বৈঠক স্থগিত করে ইসরায়েল। পরবর্তীতে বলা হয়, হামাস চুক্তির সব শর্ত মেনে নিয়েছে। মধ্যস্থতাকারীরা বিষয়টি না জানানো পর্যন্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করবে না ইসরায়েল। অবশ্য হামাসের রাজনৈতিক শাখা থেকে বলা হয় যে, ‘মধ্যস্থতাকারীদের ঘোষণা করা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হামাস’।
প্রকৃত ঘটনা তা ছিল না। মূলত: অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে চুক্তি অনুমোদনের বিষয়টি ঝুলিয়ে দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। কারণ তার জোট সরকারের উগ্র–ডানপন্থী–অর্থমন্ত্রী পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন এ বলে– ‘যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন দেয়া হলে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে’। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধবিরতির বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন দুই এক দিন। যুদ্ধবিরতিতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে– এমন ঘোষণা আসার পরও গাজায় নির্বিচারে হামলা অব্যাহত রেখেছিল ইসরায়েল। ওই ঘোষণা আসার পরও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৭৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২৩০ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ জন শিশু ও ২৫ জন নারী। ১৬ জানুয়ারি গাজায় জরুরী পরিষেবা বিভাগ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। আবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৬ জানুয়ারি জানায় যে, বিগত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় কমপক্ষে ৮১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ নিয়ে ১৫ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে গাজায় নিহত হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৮৮ জন। আর আহত হয়েছে ১লাখ ১০ হাজারে ৪৫৩ জন। তবে গাজায় নিহতের সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। সাধারণত হাসপাতালে আসা মরদেহের ভিত্তিতে নিহতের পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত বাসাবাড়ি ও স্থাপনার নিচে এখনো অনেক মরদেহ পড়ে আছে। অতিসম্প্রতি চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট– এক গবেষণা পরিচালনা করে। এই গবেষণায় দেখা যায়, ইসরায়েলি হামলায় প্রথম নয় মাসে গাজায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা উপত্যকাটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের চেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে আকস্মিক হামলা চালায় হামাস। ইসরায়েলের দাবি অনুসারে এই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি নিরীহ জনগণ নিহত হয়েছে। প্রায় ২৫০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি জনগণকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওইদিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ওই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে। তাদের মধ্যে অনেককে মুক্তি দিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী গাজায় হামাসের কাছে এখনও ৯৮ জন জিম্মি জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় রয়েছে। হামাসের ওই হামলার দিন থেকেই গাজায় নির্বিচারে আকাশ, স্থল ও জলপথে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসলায়েল। এই হামলায় নিহত হয়েছে ৪৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছে ১ লাখেরও অধিক। হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২৩ লাখ বাসিন্দার। ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে তিন ধাপে। চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ অনুযায়ী, প্রথম ধাপ হবে ছয় সপ্তাহের। এসময় ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। এর বিনিময়ে ইসলায়েলি কারাগারে বন্দী থাকা ১৯ বছরের কম বয়সী নারী ও শিশুদের মুক্তি দেওয়া হবে। একই সঙ্গে গাজা ইসরায়েলি বাহিনীর আংশিক সরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপ। এ সময় ইসরায়েলের বাকি জীবিত জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। এর বিপরীতে আরও ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া হবে। তৃতীয় ধাপে ইসরায়েলের কাছে মৃত জিম্মিদের মরদেহ ফেরত দেওয়া হবে এবং গাজা পুনর্গঠন করা শুরু হবে। এভাবে শান্তি ফিরে আসুক–এটাই বিশ্ববাসীর কাম্য।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি, চট্টগ্রাম।