যুদ্ধবিরতিতে ভারত-পাকিস্তান, ট্রাম্পের মধ্যস্থতা

সংঘাতে কার কী ক্ষতি হলো, শ্রীনগরে ফের বিস্ফোরণের অভিযোগ

| রবিবার , ১১ মে, ২০২৫ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

পাল্টাপাল্টি হামলার চার দিনের মাথায় যুদ্ধবিরতিতে গেল ভারত ও পাকিস্তান। গতকাল শনিবার বিকাল থেকে এশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় সংঘাতের ‘আপাতত’ ইতি ঘটল।

যুদ্ধবিরতির আভাস সবার আগে আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে। সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার পর আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দিচ্ছি যে, ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে একটি পূর্ণ অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়েছে। ট্রাম্পের পর অস্ত্রবিরতির বিষয়টি নিশ্চিত করে ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও।

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার সঙ্গে আপস করা ছাড়া পাকিস্তান সবসময় এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ভারতের স্থানীয় সময় শনিবার বিকাল ৫টা থেকে দুই দেশ স্থল, বিমান ও নৌপথে হামলা বন্ধ রাখতে রাজি হয়েছে। দুই পক্ষ আজ সোমবার আবার আলোচনায় বসবে বলেও জানান মিশ্রি।

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পর নয়া দিল্লিতে সংবাদ করেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, যুদ্ধবিরতির চুক্তি নয়া দিল্লি গ্রহণ করেছে। তবে দেশ রক্ষায় তারা সজাগ থাকবে। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার পরেই নিজেদের আকাশসীমা সব ধরনের ফ্লাইটের জন্য খুলে দেয় পাকিস্তান এয়ারপোর্ট অথরিটি (এপিএ)। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তার সূত্রপাত গত ২২ এপ্রিল। ওই দিন কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার শোধ নিতে বুধবার প্রথম প্রহরে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। জবাবে পাকিস্তানও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গোলা বর্ষণ শুরু করে। সেই হামলা পাল্টা হামলার চার দিনের মাথায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় যুদ্ধবিরতিতে গেল দুই দেশ।

অস্ত্রবিরতি ঘোষণার পর বিস্ফোরণ : এদিকে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ শ্রীনগর শহরে বেশ কয়েকটি ‘বিস্ফোরণ’ শুনেছেন বলে জানিয়েছেন। এর কয়েক মিনিট পর শ্রীনগরের বহু বাসিন্দা এক্স এ ভিডিও পোস্ট করে জানান, রাতের আকাশে আসতে থাকা ড্রোনের দিকে বিমান বিধ্বংসী কামান থেকে ট্রেসার ছোড়া হয়েছে, ভিডিওতে সেগুলো দেখা যাচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তান অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আব্দুল্লাহর পোস্টটি আসে। এক্সে নিজের পোস্টে আব্দুল্লাহ বলেন, যুদ্ধবিরতির কী হল? শ্রীনগরজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এরপর ভিডিওসহ তার আরেক হালনাগাদ পোস্টে তিনি বলেন, এটা কোনো অস্ত্রবিরতি না। শ্রীনগরের মাঝখানে থাকা এয়ার ডিফেন্স ইউনিট শুটিং শুরু করেছে।

গত শুক্রবার রাতভর ড্রোন হামলা ও গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র হয়। পাকিস্তান জানিয়েছে, ভারত তাদের তিনটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। এর জবাবে তারাও ভারতীয় একটি বিমানঘাঁটি এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, তার দেশ ভারতকে ‘সমুচিত’ জবাব দিয়েছে।

ভারতের সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে, তাদের পশ্চিম সীমান্তে ব্যাপক ড্রোন হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এই হামলা বেসামরিক নাগরিকদের বিপদে ফেলেছে। উভয় দেশই বলেছে, যদি অন্য পক্ষ প্রথমে পদক্ষেপ নেয় তাহলে তারা উত্তেজনা হ্রাস করার কথা বিবেচনা করতে প্রস্তুত আছে।

গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি পাকিস্তানের উপর ভারতের হামলা সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান ইচ্ছাকৃতভাবে ভারতের সামরিক স্থাপনা টার্গেট করার পর, ভারতের সশস্ত্র বাহিনী পাল্টা প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের কারিগরি স্থাপনা, কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, রেডার সাইট এবং অস্ত্র ডিপোগুলোকে বেছে বেছে টার্গেট করা হয়েছে। রফিকি, মুরিদ, চাকলালা, রহিমইয়ার খান, সুক্কুর এবং চুনিয়ায় অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিগুলোতে যুদ্ধবিমান ও অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তানের পসরুরে অবস্থিত রেডার সাইট এবং শিয়ালকোটের বিমান ঘাঁটি টার্গেটেও ভারত হামলা চালিয়েছে। এই ধরনের প্রতিশোধমূলক হামলা চালানোর সময় সাধারণ মানুষের অনেক কম ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

এছাড়া পাকিস্তানের হামলায় ভারতের সামরিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ইসলামাবাদ যে দাবি করেছে, যা অস্বীকার করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তান ক্রমাগত বিদ্বেষপূর্ণ বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করেছে। তারা বলছে আদমপুরে ভারতীয় এস৪০০ এর ক্ষতি হয়েছে, সুরাট ও সিরসায় বিমানঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে, নাগরোটায় ব্রহ্মোস স্পেস, ডেরাঙ্গিয়ারি ও চণ্ডীগড়ে আর্টিলারি অবস্থান এবং চণ্ডীগড়ের গোলাবারুদ ডিপো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা দাবি করছে। তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তানের এই মিথ্যা দাবিগুলিকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।

এদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বলছে, শুক্রবার (৯ মে) রাতে ভারত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে শুরু করে, যা চলমান উত্তেজনাকে আরও বিপজ্জনক হারে বাড়িয়ে তুলে। শনিবার ভোরে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী দাবি করেন, ভারতের পাঞ্জাবের জলন্ধরের আদমপুর ঘাঁটি থেকে ছয়টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, যার মধ্যে একটি আদমপুরের ভেতরেই ভূপাতিত করা হয়েছে, বাকি পাঁচটি অমৃতসরে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারতের নিজস্ব ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ইলেকট্রনিক প্রমাণ পাকিস্তানের কাছে আছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের শিখদের মধ্যে ঘৃণা তৈরি করতে চায় ভারত। এর আগে, ৮ মে রাতেও ভারত অমৃতসরে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। আইএসপিআর ডিজির মন্তব্য, এই বেপরোয়া পদক্ষেপ ভারতের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার স্পষ্ট ইঙ্গিত। ভারত সরকার এখন সীমান্ত আন্তঃআগ্রাসনের আড়ালে তার নিজস্ব নাগরিক এবং অবকাঠামোকে বিপদে ফেলছে। বিশেষভাবে ভারতীয় পাঞ্জাবের শিখসংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে উল্লেখ করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী বলেন, ভারতের সংখ্যালঘুরা তাদের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার। ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে অমৃতসরে শিখ সমপ্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করছে। সেখানে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক এবং দমনমূলক মনোভাবের ধারাবাহিকতা। তিনি বলেন, আমাদের সমস্ত সহানুভূতি শিখ সমপ্রদায়ের প্রতি, যারা রাষ্ট্রসমর্থিত নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সামরিক মুখপাত্র ভারতের এই পদক্ষেপকে ‘অযৌক্তিক এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক’ অভিহিত করে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ভারতের আগ্রাসী আচরণ নিয়ন্ত্রণ না করা হলে তা আরও বিস্তৃত আঞ্চলিক সংকটে পরিণত হতে পারে।

এই সংঘাতে কে কতটা ক্ষতির মুখে পড়লো : ভারতীয় সেনাবাহিনী বলছে, চলমান সংঘাতে পাকিস্তান ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। শনিবারের এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর তিন শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যোমিকা সিং, সোফিয়া কোরেশি ও রঘু নায়ার জানান, পাকিস্তানের একাধিক বিমানঘাঁটি, সামরিক স্থাপনা এবং যোগাযোগ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানও দাবি করছেসংঘাতে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় বড় ধরনের আঘাত হেনেছে তারা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, আদমপুরে ভারতীয় এস৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানা হয়েছে। সুরাট ও সিরসা বিমানঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া নাগ্রোটায় ব্রহ্মোস ক্ষেপণাস্ত্র গুদাম, ডেরাঙ্গিয়ারি ও চণ্ডীগড়ে আর্টিলারি সাপোর্ট ইউনিট এবং গোলাবারুদ ডিপোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। তবে এসব দাবি নাকচ করে দিয়েছে ভারত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোদী-শাহবাজের প্রশংসা প্রধান উপদেষ্টার
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বব্যাংকের সাথে ২৮০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি