বিকেল হতে হতে চারদিক নীরব হয়ে আসে। দুকুলের বুক যেনো কেঁপে কেঁপে উঠে। সুশান্তকা দাদার শুকনো মুখের দিকে চেয়ে ঝিম মেরে যায়। মা’র চোখে মুখে ভীষণ উৎকণ্ঠা। বাবা এখনও ফেরেনি হাটের দোকান হতে। কি যে হবে হচ্ছে তা ভাবতে ভাবতে দুকুলের বুক যেন পাথর চাপা পড়ে।
বাবার চোখে মুখে যেন ভয় লেগে থাকে। বাবা মাকে ফিস্ফিস্ করে বলছে ক’দিন ধরে। ‘দেশে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।চারদিকে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার যুদ্ধে নেমে পড়েছে। পাকিস্তানিদের দোসর চেয়ারম্যান মেম্বাররা গ্রামে গঞ্জে রাজাকার বাহিনী তৈরি করে পাকিস্তানি সৈন্যদের গ্রামে নিয়ে আসছে। পুড়িয়ে দিচ্ছে ঘরদোর বসতবাড়ি,গুলি করে করে মানুষ মারছে অহরহ…..।’
দুকুল এতসব কথার কিছু কিছু শুনে ভয়ে চুপসে যায়। আগের মতো হৈ হল্লা দুদ্দার ছুটোছুটি করে না। সুশান্তকা ধরে বসে–দুকুল কি এমন হলো যে তুই এতা চুপ মেরে গেলি? দুকুল কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠে–কাকা দেশের অবস্থা ভালো না শুনছি যে কোন দিন রাজাকারদের সাথে পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের গ্রামে হামলা করবে। ভাবছি সহায় সম্বল বাড়ি–ঘর ফেলে আমরা কোথায় যাবো। মা বাবার মুখ কতো আধাঁর দেখনি। তাহলে আমাদের কি হবে রে দুকুল!
সুশান্ত কাকাদের উঠানে আগে বিকালে মুকুল, দুকুল, জীবন, সনৎ, বাবুল, আশু, যিশু, বিশুধন, যুদ্ধধন, আদেশ আরো কতো কতো বন্ধু আসতো জমজমাট খেলা হতো হৈ চৈ হতো। এখন কেউ আসে না। কেউ আর এখন বাড়ির বের হয় না। সবাই এখন কি না ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। কখন কি যে হয়! সবার একই দুর্ভাবনা।
বাবা বাড়ি আসলেও এখন আর আগের মতো দুকুলদের নিয়ে গল্পগুজব করে না। গলা ছেড়ে কথা বলে না। দুকুল ভাবে বাবার ভেতরে কেমন যেনো ভীতি অস্থিরতা যেনো লেগেই আছে কে জানে কখন কি হয়।
বাবার মন খারাপ অবস্থা দেখে দুকুল সহজে বাবাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। যদি বাবা রেগে মেগে যায়। মা বলে-‘তোরা বাড়ির বাইরে যাস্ না তোদের বাবার মন মেজাজ ঠিক নেই।’
দুকুল ইতিমধ্যে স্কুলে হাটে শুনেছে পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমির কথা। তারা বাঙালির ন্যায্য অধিকার দাবি মেনে না নিয়ে তাদের ইচ্ছে মতো বাঙালিকে দাবিয়ে রাখবে,শোষণ করে যাবে দিনের পর দিন আরো অনেক দিন।
দুকুল অতসব শুনে বাবা মা’র দুশ্চিন্তার মুখ দেখে ভাবে কেন আমরা পাকিস্তানিদের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করবো কেন তারা দেশে হত্যা লুটের অরাজকতা চালাবে।
দুকুল ভাবে বাঙালিরা যুদ্ধে নেমেছে– মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে এবার ঠিকই পরাজিত করবে পাকিস্তানিদের। সবার মুখে হাসি ফুটবে। কারো কোন চিন্তা থাকবে না।
দুকুল অতসব মাকেও বলে। মা দুকুলের বাবাকে বলে ছেলের এতসব কথা। বাবা দুকুলকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলোয়। ভয়ঙ্কর চিন্তায় তেকেও ভেতরে ভেতরে যেনো আশার আলো দেখতে পায়। মনে হয় যেনো তাদের ছোট্ট দুকুল এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে, সে অনেক কিছু ভাবতে শিখেছে।
কিন্তু দুকুল তার ভাবনার কথা কাকে বলবে। বাবাকে বলবে, মাকে বলবে, ছোট বোনকে বলবে? কাকে যে বলবে তার কিচ্ছুই ঠিক করতে পারে না। সবকিছু ভাবতে ভাবতে ছোট্ট দুকুল আর সেই ছোট্ট থাকে না। অনেক কিছু বুঝে নেয়। পাকিস্তানিদের অবিচার অত্যাচারের কথা,পাকিস্তানি সৈন্যের জঘন্য আচরণ হামলা খুন ধ্বংসযজ্ঞের কথা। নৃশংস আচরণের কথা।
মা দুকুলের ক’দিনের ঝিম মারা ভাবগতিক দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। মনে মনে হিসাব করে কি হলো দুকুলের। দুকুল এমন চুপ মেরে গেলো কেন? ছোট বোনের সাথেও খুব একটা খেলে না। কি হয়েছে দুকুলের। তেমন কারো সাথে কথাও বলে না। কোথায় গেলো তার হাসি খুশির চেহারার ভাব।
দিন ক’দিন বাদে একদিন ঠিক ঠিক মা’র মুখোমুখী হয় দুকুল। মা’কে যুদ্ধ পাকিস্তানি স্বাধীনতা নিয়ে গড় গড় করে অকে অনেক কথা বলে যায়,তার কিছু মা বোঝে কিছুটা বোঝে না। তবে যে সব কথা শুনে মা অবাক হয়ে যায়। দুকুল মাকে বলেই বসে–মা শোনে ছেলের কথা সে ও যুদ্ধে যাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেবে,হানাদার পাকিস্তানিকে এ দেশ থেকে তাড়াবে। অতসত শুনে মা’র মুখে আর কথা জোগায় না। মা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে আদরের দুকুলের দিকে।