(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
জেল জুলুম, শাস্তি এসব ভয়কে তোয়াক্কা না করে নজরুল সবসময় নিজস্ব সত্তায় সত্যকে দাঁড় করিয়ে সুন্দরের পথে অগ্রসর পথিক হয়েছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য তিনি অনন্তকাল বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। কাব্যটি তিনি বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ–কে উৎসর্গ করেন। ১২ টি কবিতা নিয়ে গ্রন্থটি মোড়কে রূপ দেওয়া হয়েছে। এই গ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’; এটি সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার ২২ ডিসেম্বর ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়। অসহযোগ আন্দোলনের (১৯২০–১৯২২) প্রেক্ষাপটে বিখ্যাত এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখেন নজরুল। তুরস্কের বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব কামাল আতাতর্ুূককে নিয়েও নজরুল কবিতা লেখেন এই ‘বিদ্রোহী’ কাব্যে।
তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মোট সংখ্যা ২২টি। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ; অক্টোবর, ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘দোলনচাঁপা’ কাব্য। এই কাব্যের প্রথম ও পরিচিত কবিতা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। যে কবিতাটা তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় রচনা করেছিলেন; রবীন্দ্রনাথের প্রতি। আগস্ট ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘বিষের বাঁশি’। ১৯২৪ সালের অক্টোবরে গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। আগস্ট, ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থ। একই বছর তাঁর ‘ছায়ানট’ কাব্যও প্রকাশিত হয়। কমরেড মোজাফফর আহমদ ও কুতুবউদ্দিন আহমেদকে কবি ছায়ানট কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনী নিয়ে রচিত নজরুলের ‘চিত্তনামা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে। কাব্যটি উৎসর্গ করেন সিআর দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে। বাসন্তী দেবীকে তিনি মা বলে ডাকতেন। একই বছর প্রকাশিত হয় ‘সাম্যবাদী’ ও ‘পুবের হাওয়া’ কাব্য। ১৯২৬ সালে তাঁর শিশুতোষ কাব্য ‘ঝিঙেফুল’ ও ‘সাতভাই চম্পা’ প্রকাশিত হয়। একই বছর প্রকাশিত হয় ‘সর্বহারা’ কাব্য। বইটি উৎসর্গ করেন বিরজাসুন্দরী দেবীকে। যার কথায় কবি ১৯২৩ সালের কারাবন্দী অবস্থায় অনশনকালে ৩৯ দিন পর অনশন ভাঙেন। এই গ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’। ১৯২৭ সালে ‘সিন্ধু হিন্দোল’ ও ‘ফণি–মনসা’ কাব্য এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস ‘বাঁধনহারা’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালে ‘জিঞ্জির’ কাব্য এবং রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে নিয়োজিত হওয়ায় কবি বহুবার চট্টগ্রামে ছুটে এসেছেন। চট্টগ্রাম অবস্থানকালীন সময়ে রচিত অধিকাংশ কবিতা নিয়ে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘চক্রবাক’ কাব্য। একই বছর প্রকাশিত হয় ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থ; নজরুলের বিখ্যাত ‘রণ সংগীত’ এই কাব্যের অস্তর্ভুক্ত কবিতা। ১৯৩০ সালে তার আরেক সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয়শিখা’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যের জন্য কবিকে ৬মাস কারাভোগও করতে হয়েছে। এই বছরই ত্রিশাল গ্রাম ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ও প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস। ১৯৩১ সালে তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘কুহেলিকা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্ঝর’ ও ‘নতুন চাঁদ’ নামের ২টা কাব্য। ১৯৫০ সালে মহানবী (স.) এর জীবনী ভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ ‘মরুভাস্কর’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘শেষ সওগাত’ কাব্য।
তাঁর কবিতা সৃষ্টিকর্মের আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়ের যেসব ঘটনা নানা বইয়ে পড়েছি ও বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে শুনেছি, তার মধ্যে আমাকে তাঁর প্রতিভার স্ফূরণজাত একটা মুহূর্ত একেবারে আটকে রাখে তাঁর সৃষ্টিতে। একবার নজরুলকে একজন সংগীত ব্যক্তিত্ব বলেছিল বহু গান ও কবিতা তো লিখেছো, এবার ইসলামিক গান লিখো তো একটা। কবিতা ভালো হবে কিনা বা মিউজিক ডিরেক্টর সেটা গ্রহণ করবে কিনা এই দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও তিনি একটা ইসলামিক গান রচনা করলেন। সেদিনের সেই কালজয়ী সৃষ্টি অর্থাৎ গীতিকবিতাটি আজও অমর হয়ে আছে মুসলমানদের হৃদয়কাবায়। আজও দরদ মাখা সূর্যের মতো জেগে ওঠে সেই গানের সুর ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়; আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।’ কিংবা সুরের মূর্চ্ছনায় সকলের কর্ণকুহরে বেজে ওঠে ‘মুহাম্মদ নাম যতই জপি, তত মধু লাগে; নামে এতো মধু থাকে, কে জানি তো আগে!’-এর মতো অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম। যা দিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন এই মহান কবি। মুসলমানদের হৃদয় জয় করা এসব সৃষ্টির পাশাপাশি নজরুল রচনা করেছেন শ্যামা সংগীত। যা হিন্দুদের হৃদয় মন্দিরে ঘন্টার মতো বাজে প্রেমের উপাখ্যান হয়ে। এবং শোনা যায় শ্যামা সংগীত রচনার কারণে কিছু কথিত মুসলমানদের সমালোচনার উদ্গীরণ হয়েছে তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি সত্য ও সুন্দরের নিজস্ব পথে হেঁটে গেছেন। তিনি মূলত মানুষের হৃদয়কে নিজের হৃদয়ের ভেতর নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাই তিনি প্রেমময় আহ্বানে সাহসের সাথে গেয়ে গেছেন ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় মন্দির–কাবা নেই।’
নজরুল সাহিত্যের আঙিনায় এসে সংগীত জগতেও বীরদর্পে সাঁতার কেটেছেন। তাঁর রচিত সংগীতগ্রন্থসমূহ হলো-‘বুলবুল (১ম খণ্ড ১৯২৮, ২য় খণ্ড–১৯৫৮), ‘ ‘চোখের চাতক’ (১৯২৯), ‘নজরুল গীতিকা’ (১৯৩০), ‘নজরুল স্বরলিপি’– ‘চন্দ্রবিন্দু’– ‘সুরসাকী’– ‘বনগীতি’ (১৯৩১), ‘জুলফিকার’ (১৯৩২), ‘গুলবাগিচা’ (১৯৩৩), ‘গানের মালা’– ‘গীতি শতদল’– ‘স্বরলিপি’– ‘সুর–মুকুর’ (১৯৩৪), ‘রাঙা জবা’ (শ্যামা সংগীত, ১৯৬৬)।
বেদনা বিষাদ, স্বস্তিসুখ সকল মুহূর্তে মানুষের প্রিয় গানের তালিকায় বেজে ওঠে নজরুল সংগীত। বিদ্রোহের অনলে ভস্ম হলেই গেয়ে ওঠে ‘কারার ঐ লৌহকপাট।’ রোমাঞ্চ অনুভূতিতে ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়’, ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’, ‘আমায় নহে গো– ভালোবাসো শুধু– ভালোবাসো মোর গান’– এর মতো অসংখ্য কালজয়ী গান মানুষের মনে জাগিয়ে রাখে।
তাঁর গল্পগ্রন্থসমূহ হলো– ‘ব্যথার দান’ (১৯২২), ‘রিক্তের বেদন’ (১৯২৫), ‘শিউলিমালা’(১৯৩১)। তাঁর নাট্যগ্রন্থসমূহ হলো– ‘ঝিলিমিলি’ (১৯৩০), ‘আলেয়া (গীতিনাট্য, ১৯৩১), ‘পুতুলের বিয়ে (কিশোর নাটক, ১৯৩৩), ‘মধুমালা’ (গীতিনাট্য, ১৯৫৯), ‘ঝড়’ (কিশোর কাব্যনাট্য, ১৯৬০), ‘পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (কিশোর কাব্যনাট্য, ১৯৬৪)। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা নজরুল একাডেমির নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্বরত অবস্থায় তাঁর সম্পাদনায় নজরুল ইসলামের নাটকগুলোর সংকলন প্রকাশ করেছে ‘নজরুলের নাট্যসমগ্র’ শিরোনামে।
অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর অবদান ‘দিওয়ানে হাফিজ’ (১৯৩০), ছন্দে ছন্দে সাজিয়ে পবিত্র কোরআনে কারীমের ৩৮ টি সূরার অনুবাদগ্রন্থ ‘কাব্য আমপারা’ (১৯৩৩), ‘মক্তব সাহিত্য’ (১৯৩৫), এবং ইরানের জীবনবাদী কবি ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদ ‘রুবাইয়াৎ–ই–ওমর খৈয়াম’ (১৯৫৯) নামে প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন সময়ে নজরুলের ৫টি গ্রন্থ নিষিদ্ধ করা হয়। যথা: ‘যুগবাণী’ (নিষিদ্ধ– ১৯২২, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার– ১৯৪৭), ‘বিষের বাঁশি’ (নিষিদ্ধ–২৪, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার– ১৯৪৫), ‘ভাঙার গান’ (নিষিদ্ধ–১৯২৪), ‘প্রলয়শিখা’ (নিষিদ্ধ– ১৯৩০), ‘চন্দ্রবিন্দু’ (১৯৩১)। গ্রন্থ হিসেবে ‘অগ্নিবীণা’ কখনো নিষিদ্ধ হয়নি। এ কাব্যের ‘রক্তাম্বরধারিনী মা’ কবিতাটি নিষিদ্ধ হয়। আমরা তার নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকায় ভুলক্রমে ‘অগ্নিবীণা’কে হিসাব করি। সেটা আসলে ভুল। ‘অগ্নিবীণা’ গ্রন্থ দিয়ে তিনি ছড়িয়ে পড়েন দেশ থেকে দেশান্তরে–বাঙালি ও পৃথিবীর সকল শোষিত–নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে।
চলচ্চিত্রের জগতেও নজরুল রেখেছেন মৃদু সিগনেচার। ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়, ‘ধূপছায়া’ (১৯৩১) চলচ্চিত্রের পরিচালনায় রেখেছেন স্মরণীয় অবদান। কানাডায় নজরুলকে নিয়ে ফিলিপ স্পারেল ‘নজরুল’ নামে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
জীবনের উত্থানপতনের চিহ্ন তাঁর বিভিন্ন রচনায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বিদ্রোহী কবি বলার পাশাপাশি তাঁকে সাম্যবাদী কবিও বলা হয়ে থাকে। বৈষম্যহীন মানবসমাজ গঠনের প্রত্যাশায় রচিত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে তার সংকেত পাওয়া যায়। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গী ছিল। আর সেই দারিদ্র্যতাকে সংগ্রামের সাথে উতরে গিয়ে সফল হিসেবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন কবি।
এছাড়া পবিত্র রমজান মাসের পর ঈদুল ফিতরের আগমন উপলক্ষে তাঁর রচিত গীতিকা ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ যুগ যুগ ধরে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠে প্রিয় গান হিসেবে গাওয়া হয়। এমন অনেক কালজয়ী বাণী ও উক্তি রচনা করে গেছেন কবি নজরুল ইসলাম। যা আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়।
তাঁর মানবিকতা, ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দ্রোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা বোধ এবং নারী–পুরুষের সমতার বন্দনা গত প্রায় একশত বছর যাবৎ বাঙালির মানসপীঠ গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে।
রাজনৈতিক জীবনেও নজরুল ছিলেন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধীর মাধ্যমে তিনি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যোগদান করেন। কংগ্রেসের অঙ্গসংগঠন ‘মজুর স্বরাজ পার্টি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নজরুল। তিনি ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে ফরিদপুর থেকে বঙ্গীয় বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তমিজুদ্দীন খানের নিকট পরাজিত হন।
নজরুলের বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন অনেক গবেষক। ‘নজরুলের সাংগীতিক জীবন’ নিয়ে গবেষণা করে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন নজরুল গবেষক ড. করুণাময় গোস্বামী। ‘নজরুল সাহিত্যে পৌরাণিক প্রসঙ্গ’ নিয়ে গবেষণা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেলো হিসেবে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ড. সাইদুল হক শিমুল বিশ্বাস।
আবদুল মান্নান সৈয়দ আর একজন একনিষ্ঠ নজরুল গবেষক। নজরুলকে নিয়ে তাঁর রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। নজরুলের নামে প্রবর্তিত নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি, বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে। তিনি ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। যুক্ত ছিলেন নজরুল একাডেমির সঙ্গেও। ২০১০ সালে মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ‘স্কলার ইন রেসিডেন্স’ নামের সম্মানিত একটি পদে বৃত হয়ে ব্যাপৃত ছিলেন নজরুল–গবেষণার কাজে। এ ধরনের পদে বাংলাদেশে প্রথম তাঁকেই সম্মানিত করা হয়। এ গুরু দায়িত্বের ফসল হিসেবেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর মননশীল গবেষণাগ্রন্থ ‘কাজী নজরুল ইসলাম : তিন অধ্যায়।’ নজরুল–মূল্যায়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি অত্যন্ত দরকারি। কাজী নজরুল ইসলামের সমগ্র রচনাবলি বাংলা একাডেমি থেকে ‘নজরুল রচনাবলি’ (২০০৫) নামে ১২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে কবির জীবনে নেমে আসে সবচেয়ে দুঃসহ অন্ধকার। ১০ অক্টোবর, ১৯৪২ সালে (মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে) দুরারোগ্য (পিঙ ডিজিজ) ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সম্ভাবনাময় ও ঋদ্ধ এই জীবন আমৃত্যুর জন্য বাক্শক্তি হারান। ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭৪ সালে তাঁকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ সালে (মৃত্যুর ছয়মাস পূর্বে) কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলা সাহিত্যের মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক বলা হয়। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯২৯ সালে নজরুলকে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ১৯৪৫ সালে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ‘জগত্তারিণী পদক’, ১৯৬০ সালে (ভারত সরকার) ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৬৯ সালে (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়) ‘ডি–লিট’, ১৯৭৪ সালে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ‘ডি–লিট, এবং ১৯৭৬ সালে (বাংলাদেশ সরকার) কবিকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করেন।
২৯ আগস্ট, ১৯৭৬ সালে (বাংলা– ১২ই ভাদ্র, ১৩৮৩) সকাল ১০ ঘটিকায় ঢাকার (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ৭৭ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে তিনি দুনিয়ার সফর শেষ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নিভে যায় বাংলাদেশের এবং পুরো বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল এই আলোকশক্তি।
প্রেমময়, বিদ্রোহী ও আধ্যাত্মিক এই কবির ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। সহস্র শতাব্দী পরেও সকলের হৃদয়ে ভালোবাসার নীল অপরাজিতা হয়ে বেঁচে থাকবেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।