চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সিআরবির মতো একটি প্রাকৃতিক- সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে হাসপাতাল চান না। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চট্টগ্রামে আরও আধুনিক উন্নতমানের হাসপাতাল চান; তবে সেটা সিআরবি নয়- অন্য যে কোনো স্থানে। তাদের মতে চট্টগ্রামে আরও অনেক জায়গা আছে, সেখানে হাসপাতাল করা হোক। তাতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবিতে হাসপাতাল তারা চান না। হাসপাতালের জায়গায় তারা সবুজ বনায়ন করে সিআরবির সৌন্দর্য বৃদ্ধির কথা বলেছেন এবং সিআরবির হাসপাতালের ব্যাপারে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেন।
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী
সিআরবির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে আমি হাসপাতাল চাই না
চট্টগ্রামের সিআরবিতে প্রাইভেট হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে সুশীল সমাজ, নানান শ্রেণী পেশার মানুষ লাগাতার আন্দোলন করছেন সিআরবির শিরীষ তলায়। সিআরবির মতো একটি প্রাকৃতিক-নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিষয় নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি আজাদীকে বলেন, ইতোমধ্যে আমি পত্র-পত্রিকায় দেখলাম সিআরবিতে একটি হাসপাতাল হবে। আমার দৃষ্টিতে সিআরবি হলো চট্টগ্রামের ফুসফুস। আমার প্রথম কথা হলো চট্টগ্রামের ফুসফুস নষ্ট করে সিআরবির মতো একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকায় আমি হাসপাতাল চাই না। এখানে হাসপাতাল করলে চট্টগ্রামে ফুসফুস নষ্ট হয়ে যাবে। আমি হাসপাতাল হোক সেটা চাই। তবে সেই হাসপাতাল সিআরবিতে নয়, হাসপাতল অন্য কোনো স্থানে হোক। চট্টগ্রামের সুদীর্ঘ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে হাসপাতাল চট্টগ্রামবাসী চায় না। সাগর মেঘলা, গিরি কুন্তলা, কবির কল্পনার ভেনিস প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রাম। আজকে প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রামের সৌন্দর্য বেহাত হতে চলেছে। কোন অবস্থাতেই এই চট্টগ্রামের সৌন্দর্য যেন ব্যাহত না হয়।
এই চট্টগ্রাম ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি বিজড়িত এলাকা। এই চট্টগ্রাম থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। একই ভাবে এই চট্টগ্রাম থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ৬ দফার বাণী জহুর আহমদ চৌধুরীর মাধ্যমে প্রচার করেছিলেন। জাতির পিতার মহান স্বাধীনতার ঘোষণাও এই চট্টগ্রাম থেকে হয়েছিল। যে চট্টগ্রাম এক সময় প্রাচ্যের রাণী বলা হতো, ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর ছিল। আজকে চট্টগ্রামে অনেক কিছু নেই। চট্টগ্রামে কোনো স্মৃতি সৌধ নেই। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের আজকে একটি দাবি- চট্টগ্রামে একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ করা হোক। চট্টগ্রামের সকল উন্নয়ন প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে তুলে নিয়েছেন। সুতরাং আমি এই বিষয়ে (সিআরবিতে হাসপাতালের বিষয়ে) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবেন না।
মোছলেম উদ্দিন আহমদ
আমি চট্টগ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি চাই, পরিবেশের ক্ষতি হোক সেটা চাই না
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের ব্যাপারে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ দৈনিক আজাদীতে তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি চাই, তবে সেটা পরিবেশের ক্ষতি করে হোক সেটা চাই না। পরিবেশ বিনষ্ট করে কিছু হোক সেটা কামনা করি না।
হাসপাতাল আমাদের দরকার আছে। তবে হাসপাতাল করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করে কিছু করাটা উচিত হবে না। আমরাও সেটা চাই না। পত্র-পত্রিকায় সিআরবিতে হাসাপাতাল নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার পর আমরা আওয়ামী লীগ নেতারা (মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ) এক সাথে বসেছি। আমরা এই বিষয় নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলের সাথে আলোচনা করছি। আমাদের কথা বার্তা চলছে। যে কোনো সিদ্ধান্ত আসার পর পরবর্তীতে সেটা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের জানাবো।
তিনি বলেন, সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে চট্টগ্রামের নানা শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি, আমরা এটার একটা সুন্দর সমাধান চাই। সিআরবি আমাদের চট্টগ্রামের একটি প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকা। সিআরবির সৌন্দর্য কিভাবে অক্ষুণ্ন রাখা যায় সেটাও ভাবতে হবে। সৌন্দর্য হানি করে কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। আমরাও মনে প্রাণে সেটা চাই না।
এম এ সালাম
রেলের ৬ একর জায়গায় বনায়ন করলে সিআরবির সৌন্দর্য আরো বাড়বে
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালামের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি গতকাল আজাদীকে বলেন, আমাদের হাসপাতাল দরকার তবে এটা যে সিআরবিতে হতে হবে সেটা নয়। রেলের জমিতে হতে হবে সেটাও নয়। হাসপাতালের জন্য রেল যদি জায়গা দিতে চায়-সেটা সিআরবি ছাড়া অন্য জায়গায় দিতে পারে। রেলের যে ৬ একর জায়গার উপর হাসপাতাল করার কথা শোনা যাচ্ছে- আমার প্রস্তাব হলো এই ৬ একর জায়গায় বনায়ন করলে, গ্রীণ করে ফেললে সিআরবির সৌন্দর্য আরো বাড়বে। আমরা কথা হলো হাসপাতাল হোক সেটা সরকারি বা বেসরকারি যেটাই হোক-সেটা করার মতো চট্টগ্রামে অনেক জায়গা আছে। সেটা রাজাখালীতে হতে পারে, কল্পলোকে হতে পারে। ফৌজদারহাটে হতে পারে, বে-টার্মিনালের পাশে জায়গা আছে সেখানে হতে পারে, বায়েজিদ এলাকায়ও হতে পারে অথবা দক্ষিণ কাট্টলীতে সিটি কর্পোরেশনের জায়গা আছে ওইদিকে হতে পারে। চট্টগ্রামে তো জায়গার অভাব নেই। সেটা সিআরবিতে হতে হবে কেন?
সিআরবিতে রেলওয়ের যে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল আছে সেটা আধুনিকায় করে জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তর করা হোক। তাহলে সর্বস্তরের মানুষ এখানে চিকিৎসা পাবে। সিআরবির হাসপাতাল নিয়ে চট্টগ্রামের সুশীল সমাজ, নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বিষয়টি আমরা অনুধাবনের জন্য চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা (চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার) গত বুধবারে রেলের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প এলাকায় গিয়েছিলাম। আমাদেরকে প্রকল্প পরিচালক প্রকল্প এলাকায় নিয়ে গেছেন। আমি যেটা দেখলাম-এখানে ৫শ’ শয্যার হাসপাতাল হবে, ১শ’ আসনের মেডিকেল কলেজ হবে। হাসপাতালের মুখ এসে পড়বে সিআরবির সাত রাস্তার মুখ বরাবর। এখানে হাসপাতাল হওয়ার পর নার্স ইনস্টিটিউট হবে। স্টাফ কোয়ার্টার হবে। পুরোটা কমার্শিয়াল স্পেস হয়ে যাবে। এতে সিআরবি যে একটি হেরিটেজ সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। তীব্র গরমের দিনে বাইরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি থাকলে সিআরবিতে আসলে সেটা ৩০/৩২ ডিগ্রি হয়ে যায়। এরকম একটি স্থানে হাসপাতাল করাটা ঠিক হবে না। চট্টগ্রাম এভারকেয়ার অনন্যা আবাসিক এলাকায় হাসপাতাল করেছে। তারা (ইউনাইটেড গ্রুপ) চাইলে কল্পলোকে করতে পারে।
মফিজুর রহমান
সিআরবির মতো হেরিটেজ এলাকায় হাসপাতাল হোক সেটা আমি চাই না
সিআরবিতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে হাসপাতাল হোক সেটা চান না দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। তিনি গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় আজাদীকে বলেন, সিআরবির মতো একটি হেরিটেজ এলাকায় হাসপাতাল হোক সেটা আমি চাই না। আমি আধুনিক-উন্নতমানের হাসপাতালের পক্ষে। আমরা সবাই আধুনিক হাসপাতালের পক্ষে। তবে পরিবেশ নষ্ট করে-একটি হেরিটেজ এলাকায় হাসপাতাল হলে শত বছরের ঐতিহ্য সিআরবি তার স্বকীয়তা হারাবে। হাসপাতাল চট্টগ্রাম শহরের অন্য যে কোনো জায়গায় হোক সেটাকে আমরা স্বাগত জানাবো। চট্টগ্রামবাসী স্বাগত জানাবে।
সিআরবির মতো একটি হেরিজেট জোনে কোনোভাবেই স্থাপনা করার অনুমোদন দেয়ারও সুযোগ নেই। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ-সিডিএর মাস্টার প্ল্যানের সাথে সাংঘর্ষিক।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিজুর রহমান আরো বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা ও বৃক্ষরোপণে আন্তরিক। তিনি প্রতি বছর গাছ লাগান। গাছ ভালোবাসেন, প্রকৃতি ভালোবাসেন। গাছ লাগানোর উপর পুরস্কার দেন। তিনি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে হাসপাতাল করার পক্ষে মত দিবেন না। সিআরবিতে হাসপাতাল নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর যে আবেগ-অনুভূতি আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামবাসীর অনুভূতি উপলব্দি করে সিদ্ধান্ত দেবেন।
তবে আমরা একটি সূত্র থেকে জেনেছি, চট্টগ্রামবাসী যদি সিআরবিতে হাসপাতাল না চায় তাহলে সেখানে হাসপাতাল হবে না বলে সরকারের উচ্চ মহল থেকে বলা হয়েছে।