যানবাহনের ক্রমবিবর্তন

স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম

কুমার প্রীতীশ বল | সোমবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

একসময় এ শহরের মানুষ হেঁটে, পালকিতে চড়ে, নৌপথে যাতায়াত করত। তখন ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা’ নামত। রূপকথার গল্পের মতো জোনাকিরা ঝিলমিল করত শহরের অলিগলিতে। সেসব দিনের কথা, সে সমস্ত পূর্ব পুরুষের কথা মনে করে সেই কুপি জ্বলা পথ, ছায়াঘোমটা পথ, ফেরিওয়ালার গলা ফাটিয়ে চমকে দেওয়া পথ, কাটাপাহাড়, জামাল খাঁন, বাদশামিয়া চৌধুরী সডক, মেডিকেল কলেজের দক্ষিণপশ্চিম কোণ, চট্টেশ্বরী রোড, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ফিনলে গেস্ট হাউসের নিকটবর্তী পাহাড়ি ঢালু আর সমতল ভূমির পথ, রেলওয়ের পাহাড় ঘেষা সুনসান নীরব পথ ধরে হাঁটতে ভালো লাগত।

আমাদের এক অঞ্চলদা আছেন। অনেক লম্ব পথ নানান গল্পতর্ক করে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো হাঁটিয়ে নিয়ে যেতেন। বুঝে না বুঝে তাঁর পিছু নিয়েছি পথের ক্লান্তি ভুলে, বিরক্ত হইনি। এমনই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের কাল কিংবা মহাকাল।

হাজারদু’হাজার বছর আগে মানুষ নৌপথে বেশি যাতায়াত করত। যাতায়াতের আদিমতম বাহন ছিল নৌকা। নৌকা বানাত কলা গাছ কিংবা বাঁশ দিয়ে। চট্টগ্রামের বিশেষ এক ধরনের নৌকার নাম সাম্পান। সাম্পানের সামনের দিকটা উঁচু বাঁকানো, পেছনটা সোজা। কখনও পাল থাকে, কখনও থাকে না। এক সময় বড় আকারের সাম্পান দেখা যেত কর্ণফুলীতে। সাতজন মাঝি থাকত, থাকত তিনকোণা আকারের তিনটি পাল। সাম্পান একটি ক্যান্টনিজ (চাইনিজ স্থানীয় ভাষা) শব্দ। ‘সাম’ মানে তিন। ‘পান’ মানে কাঠের টুকরো অর্থাৎ ‘তিন টুকরো কাঠ’। এক সময় চট্টগ্রামে তৈরি হতো সমুদ্রে চলাচল উপযোগী বড় জাহাজ। চট্টগ্রাম নৌশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে বণিকরা চট্টগ্রামে আসত নৌকা কিনতে। এখানকার ব্যবসায়িরা জাহাজে ব্যবসা করতে যেত মালাবার, জাভা, আন্দামান, মালদ্বীপ, লাক্ষাদ্বীপ, সুমাত্রা। চট্টগ্রামের নাবিকদের দুরন্ত সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সুখ্যাতি ছিল। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৌকায় পরিবর্তন এসেছে। এখন নৌকা দাঁড় টেনে চালায় না। বদর বদর করে মাঝিরা গায় না।

মধ্যযুগে জলদস্যুরা ডাকাতি করত আসত নৌকায়, যুদ্ধও করত। বর্ষাকালে নৌপথে ডাকাত আসত ডাকাতি করতে। চট্টগ্রামের এমন একটা জায়গা শিকলবাহা। রাত নিশিতে ওপথে যেতে গা ছমছম করত। শৈশবে সাম্পানে কর্ণফুলী পার হয়েছি অনেকবার। জেঠিমার বাবার বাড়ি গিয়েছি। মনে পড়ে, সেসব খেয়া ঘাটের কথাখেলার ঘাট, ভারম্ভা ঘাটের কথা।

নৌকা, নৌকার মাঝি বাংলার শিল্পসাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছে। নন্দিত গানও আছে। সেসব গান লোকসংস্কৃতির মহান সম্পদ। এখন আর গুরগুরাইয়া চলে না সাম্পান। সাম্পানের সেই ‘ক্যাঁ কোরত, ক্যাঁ কোরত’ সুর এখন আর নেই। রাত নিশিতে সাম্পান ভেড়ায় না রঙিলা মাঝি। সেই সাম্পানওয়ালা নেই, সাম্পানও নেই। এখন নদী দাপিয়ে বেড়ায় ইঞ্জিন নৌকা। স্যালো নৌকার তেলমোবিল নদীর পানি দূষিত করছে।

লোকশিল্পী আবদুল গফুর হালী লেখকগবেষক নাসিরউদ্দীন হায়দারকে বলেছেন, ‘আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগেও আমার গ্রাম পটিয়ার রশিদাবাদ থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার একমাত্র মাধ্যম ছিল সাম্পান। সন্ধ্যায় শঙ্খ খালের ঘাটে গিয়ে সাম্পানে উঠতাম, চানখালী খাল দিয়ে মধ্যরাতে সাম্পান পৌঁছাত পটিয়ার ঈন্দ্রপুলে। সেখানে যাত্রাবিরতি। বাড়ি থেকে আনা ‘ভাতের মোচা’ খুলতাম আমরা। খাওয়ার পর আবার রওনা দিতাম। সকালে চাটগাঁ শহরের সদরঘাটে পৌঁছাত সাম্পান। তখন তো গাড়ি ছিল না। সাম্পান ছিল মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’ তখন পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসতে একদিনের বেশি লাগত। লোকগানের আরেক শিল্পী এম এন আখতারের কথাতেও একই সুর। তিনিও রাউজানের মোহাম্মদপুর গ্রাম থেকে শহরে আসতেন সাম্পানে চড়ে। আমরাও শৈশবে খেয়া নৌকায় পারাপার হয়েছি। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাইতে দেখেছি বিশাল গদি নৌকা। গদি নৌকায় গ্রামে চাক্তাই থেকে সওদাগররা মালামাল পাঠাতেন। গ্রামের হাটবাজারে মালামাল যেত নৌকায়। চাক্তাইতে গ্রামীণ সওদাগররা স্লিপ দিয়ে আসতেন। দোকানদার মালামাল নির্ধারিত নৌকায় পাঠিয়ে দিতেন। তাঁরা জানতেন, কোন গ্রামের নৌকা কোথা থেকে ছাড়ে। সে নৌকার মাঝির নামও জানতেন। নাম বলতেই সওদাগররা বুঝে যেতেন কোন গ্রামের নৌকা। কিংবা গ্রামের নাম বললে বলে ফেলতেন মালামাল কার নৌকায় উঠবে।

খুব ইচ্ছে করত, তাঁদের মতো নৌকায় যাওয়াআসা করি। সে সখ মিটাতে একদিন আমি, পারভেজ, পঞ্চানন মামা এয়াকুবনগর ঘাটে গিয়ে নৌকা ভাড়া করি। প্রাচীনকালের সেই দাঁড় টানা নৌকা নিয়ে ছুটলাম আনোয়ারার উদ্দেশে। শহরে কঠিন হরতাল চলছিল। আনোয়ারা পঞ্চানন মামার বাড়ি যখন পৌঁছি, তখন ভরদুপুর। পুরুষেরা দুপুরের আহারে বসেছেন। কী আর করবেন? অতিথি নারায়ন বলে কথা। আবার রান্না হলো। খাওয়াদাওয়া করে বিরাট বাড়ির চারদিক ঘুরে দেখি। মস্ত একটা শিউলি গাছ। ফুলের গন্ধে মোমো করছে। গাছতলা শিউলি ফুলে ভরে গেছে। দেখে মনে হয়, শিউলি তলায় দুধের বন্যা বয়ছে। বিকেল গড়িয়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পা ফেলে সন্ধ্যা নামল। ঐ কালো বিড়ালখানা চুক চুক করে খেয়ে নিল দিনের সমস্ত রোদ্দুর। আবার যাত্রা শুরু করি। পথঘাট আবছা লাগছে। দূরে কোথাও কেরোসিনের কুপি বাতি, কোথায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। কর্ণফুলীর পানিতে ছলাত ছলাত শব্দ। মাঝি দাঁড় টেনে ক্যাঁ কোরত, ক্যাঁ কোরত করতে করতে হাজির হয় এয়াকুবনগর ঘাটে। পঞ্চানন মামা আজ নেই। স্মৃতিটুকু এখনও সজীব। কিছু মানুষ আছেন ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকেন। মায়ার মতো ছড়িয়ে থাকেন অন্তরে। তাঁরা হাসেন ফুলের হাসি, নিরবতার শব্দচাষি, জ্যোৎস্না বিলান অন্তরে। পঞ্চানন মামা ছিলেন তেমনই একজন।

১৩৯৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির রাতে আবার কর্ণফুলীতে ভেসে বেরিয়েছিলাম আমি হালিম ভাই, পারভেজ ভাই। সেরাতে ছিল ভরা পূর্ণিমা। এয়াকুবনগর ঘাটে হালিম ভাইয়ের ট্রলার ছিল। ওটাতে মাঝিমাল্লারা রান্না করল। নৌকায় খাওয়াদাওয়া হলো। নৌকায় ভাসতে ভাসতে অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করি! দূরে নৌকায় কুপি বাতিগুলো বাতাসে একবার নিবে আরেক বার জ্বলে। চাঁদের আলোর অপূর্ব রোশনায় স্বর্গীয় মাদকতা তৈরি হয়েছিল। নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে ধবল দুধের মতো পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছি। নিজেকে তখন শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তশ্রীকান্ত মনে হয়েছিল। এরপরে আরও এক সন্ধ্যায় নৌবিহারে গিয়েছিলাম।

নদী আর সময় নাকি গোপনে বয়ে যায়। হয়ত যায়। সড়ক ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে যুক্ত হয় ঘোড়ার গাড়ি। ইংরেজ আর দেশীয় জমিদাররা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ত। বিয়েতে, নাইওড়ি নিতে ঘোড়ার গাড়ি ডাকত। চট্টগ্রামে প্রথম কে ঘোড়া গাড়ির প্রচলন করেন জানিনা। উপমহাদেশে ইংরেজরা চলাচলের সুবিধার জন্য ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করে। এটি টমটম নামে পরিচিত। আরও একটা নাম আছেএক্কাগাড়ি। চালকদের বলা হয় কচোয়ান। ঘোড়ার গাড়ি একটা কিংবা দুটো ঘোড়া দিয়ে চালানো হতো। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চট্টগ্রামে ঘোড়ার গাড়ি ছিল।

গরুর গাড়ি নৌকার সমকালীন। বিশেষ করে, শুকনো মৌসুমে নৌকার বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গরুর গাড়ির চালককে বলা হতো গাড়োয়ান। বিয়ে, বাপের বাড়ি নাইওর যেতে ধনীর দুলালীর জন্য গরুর গাড়ি আসত। শহর চট্টগ্রামে কোঁওঁওঁওঁ শব্দে গরুর গাড়ি চলতে আমিও দেখেছি। তখন মানুষ নয় মালামাল টানত। চাক্তাইখাতুনগঞ্জ, সদরঘাট, বন্দর এলাকায় বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হতো। গরুর গাড়ি নিয়েও লোক গান আছে। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’এসব গানের অন্যতম।

হঠাৎ ১৯০৫ সালের ২৯ অক্টোবর রুক্ষ পথের বুক মাড়িয়ে শহর চট্টগ্রামে নামে এক যন্ত্রদানব। একজন ইংরেজ ভদ্রলোক ভুঁ করে চালিয়ে গেল মটর গাড়ি। তিনি রেলওয়ের কর্মকর্তা মি. জেমস। তিনিই চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম মটর গাড়ি চালান। এ শুনে মানুষ অবাক। যারা দেখেছে তারা হতভম্ব। এ কী কান্ড? একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাইয়ি করে। এও সম্ভব! আশ্চর্যের অন্ত নেই। বিস্ময়ের শেষ নেই। সবাই চেয়ে থাকে গাড়িটা যখন যায়। এ আবার কী জিনিস! অনেকে দেখার জন্যও আসে। পরিবর্তনটা মেনে নিল না কোচোয়ানরা। তারা প্রতিবাদ করল। ১১ডিসেম্বর ধর্মঘট আহবান করে। একটি সফল ধর্মঘটের মাধ্যমে কোচোয়ানরা শহর চট্টগ্রামে মটর গাড়ি চালনার প্রতিবাদ জানাল।

বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত প্রথম সড়ক নির্মাণ করেন। এটি ছিল প্রথম উন্নতমানের সড়ক। এরপরে শাহ সুজা আরাকান সড়ক নির্মাণ করেন। ১৭৭৪ সালে চট্টগ্রামকুমিল্লাঢাকা সড়ক নির্মাণ হয়। ১৮৫৪৬৫ সালে এ সড়কটিকে কলকাতাবার্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সম্প্রসারণ করা হয়। সড়কটি ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত। তবে ১৮৮৪ সালে চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড গঠন হলে সড়ক নির্মাণের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব লাভ করে। এরপর ইউনিয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সড়কের নির্মাণ কাজ চলে। তখন শহরের সঙ্গে সংযোগ সড়ক, পুল, কালভার্ট নির্মাণে গুরুত্বারোপ করা হয়।

সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনেও আসে পরিবর্তন। মানুষ আর নৌকা, গরুঘোড়ার গাড়িতে চলাচলে সীমাবদ্ধ থাকল না। মোটরগাড়ি, রেল, বিমানের ব্যবহার ক্রমে বাড়তে থাকে। এখন তো দোতলা বাসও চলে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্ঞান অন্বেষণের এক বিরল সাধক
পরবর্তী নিবন্ধদুই এমপি মারা গেলেন, কালুরঘাট সেতু হলো না : নতুন করে আশার আলো