“সুমনা : একে হার স্বীকার বলে না। আমরাও চাষি মজুর প্রজা, ওরাও তাই। সব চাষি মজুরই ভাই ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ চলে না। এমন বিবাদে রাজা, সেনাপতি শেঠদেরই সুবিধে হয়। আমরা সে সুবিধে করে দিতে পারি না। … [গাঁয়ের লোক ও সুমনা দুজনেই চলে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পরই আসে অচলগিরির রাজা। তার চুল উস্কুুখুস্কুু, দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, পোশাকও অগোছালো।] রাজা: (পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে) ওই পাহাড়টিই আমার শত্রু। ওরই জন্যে আমি লাল সূর্যটি দেখতে পাই না। ওকে সরাতেই হবে এখান থেকে। তাইলেই আমি লাল সূর্যটি দেখতে পাব। আঃ কী চমৎকার, টকটকে লাল সূর্য। [দূরে শোনা যায় কোলাহল; সবটা বোঝা যায় না, কেবল শেষের কথাটা শোনা যায় : সরিয়ে দেব, সরিয়ে দেব।] রাজা : (খুব খুশী হয়ে) হ্যাঁ, এই তো আমার রাজ্যের প্রজারা পাহাড় সরাতে লেগে গেছে। আর তা না করে কি পারে ? আমি অচলগিরির রাজা। আমার আদেশ অমান্য করে কার এমন সাধ্য! পাহাড় সরিয়ে না দিলে ওদের সবাইকে আমি আগুনে পুড়িয়ে মারব না? [এবার কোলাহলটা অনেক কাছে এগিয়ে আসে : সরিয়ে দেব, সরিয়ে দেব।] রাজা : (একটু অগ্রসর হয়ে) এই তো ওরা এদিকেই আসছে। [ছেলে–মেয়েরা আসে। তাদের সবার হাতেই সাতরঙা ফুল।] রাজা : তোমরাই সরিয়ে দেবে? ছেলেমেয়েরা : হ্যাঁ, আমরাই সরিয়ে দেব। রাজা : কিন্তু তোমরা কি পারবে? তোমরা তো সব এতটুকুন ছেলেমেয়ে! এতো বড় পাহাড় তোমরা সরাবে কী করে? একটি মেয়ে: বাহ্ রে! আমরা পাহাড় সরাব না। আমরা তো রাজার মাথা সরিয়ে দেব। রাজা : কী? কী বলছিস তোরা? একটি মেয়ে : ওরে! তোরা চিনতে পারছিস না? ও–ই তো আমাদের অচলগিরির রাজা। … সুবচন : এ্যাঁ, রাজার মাথা সরিয়েছে? কারা, কারা এরা? রাজ্যে এই আগুন জ্বালাল কারা? সুমনা : এরা সব রাজ্যের নিরীহ চাষি মজুর প্রজা। আগুন এরা লাগায়নি। রাজা, সেনাপতি আর শেঠেরা মিলে এতকাল যে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে, যে আগুনে এরা চিরকাল ধরে তিলে তিলে পুড়েছে– সে আগুনই আজ ওরা নিভিয়ে দিল। সুবচন : রাজাকে হত্যা করে ওরা আগুন নিভিয়ে দিল? এমন অদ্ভুত কথা তো জীবনেও শুনিনি। মহারাজ নেই, রাজ্য এখন কে চালাবে? দুঃশীল সেনাপতিই–বা কোথায়? সুমনা : দুঃশীল সেনাপতিও খতম। দুঃশীলরা খতম হলে, অপদার্থ রাজারা না থাকলে, রাজ্য চালানোর আর কোনো চিন্তাই থাকে না। রাজ্য চাষি মজুর প্রজাদের। প্রজারাই চালাবে তাদের রাজ্য। সুবচন : আর এক অদ্ভুত কথা। প্রজারা আবার রাজ্য চালায় কেমন করে? প্রজা প্রজাই, আর রাজা– রাজা। সুমনা : এ আপনাদের ভুল, মন্ত্রী মহাশয়। এতদিন পর্যন্ত এসব ভুল কথাই আপনারা মানুষকে শিখিয়েছেন। এবার নতুন দিন এসেছে। নতুন কথা বলতে হবে সবাইকে।”
ত্রিকালদর্শী বিদগ্ধ ও সংস্কৃতিমান যতীন সরকার (জন্ম: ১৮ আগস্ট ১৯৩৬) রচিত খোলা নাটক বা মুক্তনাটক ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’ –এর কিছু সংলাপ উপর্যুক্ত বাক্যগুলো। ১৯৭৬ সালে ৩ মার্চ যতীন সরকার গ্রেফতার হন। ময়মনসিংহের কারাগারে বসে রচনা করেন দুটি গ্রন্থ। একটি ‘ব্যাকরণ ভয় অকারণ’, অন্যটি তাঁর প্রথম সৃজনকর্ম ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’ নাটক। নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সাহিত্যিক অধ্যাপক স্বপন ধর সম্পাদিত ‘জলদ’ যতীন সরকার সংখ্যায়। ঢাকার ‘কথাপ্রকাশ’ ২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। প্রচ্ছদ করেছেন সমর মজুমদার, প্রকাশক জসিম উদ্দিন এবং চৌষট্টি পৃষ্ঠার নাট্যগ্রন্থটির মূল্য দুইশত টাকা।
নাটকটিতে দেখা যায় অচলগিরি রাজ্যের পূর্বদিকে আছে একটি পাহাড়। পাহাড়ের সৌন্দর্যে বিমোহিত রাজ্যের প্রজাগণ। গাছগাছালি, ঝরনা, ছড়া, পাখপাখালি, ফুল ও ফলের বিপুল সমারোহ পাহাড়টিতে। পাহাড়টিতে মূল্যবান গাছ যেমন আছে, তেমনি আছে মূল্যবান পাথর, মণি–মাণিক্য, হীরা–পান্না–চুনির খনি। অচলগিরির রাজার রাজপ্রাসাদ থেকে চমৎকারভাবে অবলোকন করা যায় পাহাড়টি। পাহাড়ের ওইপাড়ে আছে ছোট্ট মনিপুর রাজ্য। মনিপুরের রাজার আমন্ত্রণে গিয়ে সেই রাজ্যের পুবদিকে কোনো পাহাড় না থাকায় ভোরবেলার আরেক সৌন্দর্য উপভোগ করলেন অচলগিরির রাজা। ফিরে এসে ভাবতে লাগলেন, নিজের রাজ্যের পুবদিকের পাহাড়টি যদি সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তিনিও মনিপুরের রাজার মতো আরেকটু আগে সূর্যের মুখ দেখতে পাবেন। তাঁর এই অভিলাষ মন্ত্রীপরিষদে জানালে সুপরামর্শদাতা মন্ত্রী সুবচন রাজাকে বোঝাতে থাকেন, এটা সম্ভব নয় এবং এই কাজ করলে রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। কেননা, ওই পাহাড়টিই অচলগিরি রাজ্যের ধনসম্পদের বিপুল আধার। কিন্তু, কুমন্ত্রণাদাতা মন্ত্রী দুর্জন শেঠ রাজার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কুচিন্তক সেনাপতি দুঃশীলকে কাজে লাগিয়ে অচলগিরির পাহাড়টি অপসারণে প্রজাদের উদ্দেশে আদেশ জারি করান। রাজপক্ষের সর্দার জন–হিতাকাঙ্ক্ষী সুযশ বিষয়টিতে মর্মাহত হন। এদিকে চলে অন্য খেলা; কুমন্ত্রণাদাতা মন্ত্রী দুর্জন আছে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজে অচলগিরির রাজার আসনে আরোহন করার পাঁয়তারায়। একই প্রচেষ্টায় লিপ্ত কুচিন্তক সেনাপতি দুঃশীলও। এই মানসে সে রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল আর উত্তরাঞ্চলের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে। জন–হিতাকাঙ্ক্ষী সর্দার সুযশ যখন নিরুপায়, তখন তাঁর নাতনি বুদ্ধিমতি সুমনা এগিয়ে আসে। ইতিমধ্যে সে সর্দার সুযশের সাথে কুমন্ত্রী দুর্জন শেঠ ও কুচিন্তক দুঃশীলের কথোপকথন আড়াল থেকে শুনে ফেলে। সে তার বন্ধু–বান্ধবদের সহযোগিতায় এবং গ্রামের মানুষদের কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজা ও সেনাপতিকে পরাস্ত করে সরিয়ে দেয় এবং কুমন্ত্রণাদাতা দুর্জন শেঠকে বন্দি করে। পরবর্তী ঘটনা এই লেখার শুরুতে উদ্ধৃত সংলাপে আছে। সুমনা এই নাটকে নাট্যকারের মানসপ্রতীমা। অচলগিরির রাজা, কুমন্ত্রী দুর্জন শেঠ আর সেনাপতি কুচিন্তক দুঃশীল যুগে যুগে দেশ ও সমাজবিধ্বংসী কুপ্রবৃত্তির কুশীলব। সুবচন মন্ত্রীগণ কুচক্রীদের আগ্রাসনে হয়ে পড়েন কোণঠাসা। শেষ বিচারে সুবচনদের কথা সঠিক প্রমাণিত হয়। আর অচলগিরি রাজ্যের শিশু–কিশোর সাধারণ জনতা বুঝিয়ে দিয়েছে– জয়, শেষ পর্যন্ত জনতারই হয়।
যতীন সরকার নাটকটি লিখেছেন কারাগারে বসে। ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ তাঁকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। বন্দী জীবনে তিনি পেয়েছেন পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হওয়া আবদুল হামিদ, জননেতা তোফায়েল আহমেদ–সহ আরও নেতাকর্মীকে। দীর্ঘ আঠারো মাসের বন্দীজীবনে তিনি কারাগারে বসে তিনটি কাজ করেন। একটি হচ্ছে ‘ব্যাকরণ ভয় অকারণ’ গ্রন্থ রচনা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে কিছু প্রবন্ধ–নিবন্ধ রচনা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে তাঁর প্রথম সৃজনশীল কর্ম ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’ নাটক রচনা। এই নাটককে কারাসাহিত্যও বলা চলে। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকও কারাসাহিত্য। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর কারাসাহিত্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ তো বাঙালির জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা যতীন সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত প্রধান বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত হন ২০১০ সালে। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন ২০০৭ সালে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের জন্ম–মৃত্যু দর্শন’ গ্রন্থটিই তাঁকে ব্যাপকভাবে আলোচনায় নিয়ে আসে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে। ‘মুক্তধারা’ প্রকাশিত বইটি হচ্ছে ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। ১৯৬৭ সালে তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত ‘ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক’ –এর জন্য প্রবন্ধ রচনা করে তিনি ১৯৬৭ সালে এই পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর সে সময়কার কিছু লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক পাকিস্তানে (দৈনিক বাংলা)। এক্ষেত্রে তিনি দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব ও সাহিত্যিক সরদার জয়েন উদ্দীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর সে সময়কার কোনো লেখালেখি সংরক্ষণে নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা– বিরোধী শক্তি তাঁর বাড়ি থেকে বইপুস্তক ও লেখালেখি সব লুট করে নিয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে কারামুক্তির পর ইসমাইল মোহাম্মদ সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকে। ১৯৮৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাঁর পঁয়ত্রিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা প্রতিভা’ প্রকাশ করে ঢাকার ‘কথাপ্রকাশ’। একই প্রকাশনা সংস্থা ২০২২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’ নাটকটি।
যতীন সরকার ১৯৪৬ সালে প্রাথমিক পরীক্ষায় (৪র্থ শ্রেণি) উত্তীর্ণ হয়ে নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক (বর্তমান এসএসসি) পাশ করেন। ১৩জন পরীক্ষা দিয়ে তাঁরা মাত্র দুজন পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন নেত্রকোনা কলেজ থেকে, ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এসময় নেত্রকোনার বারহাট্টা স্কুলে দুইবছর শিক্ষকতা করেছেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৩ সালে। দশমাস গৌরীপুর স্কুলে শিক্ষকতা করার পর যোগদান করেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলা বিভাগে। ২০০২ সালে এই কলেজের অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন।
তিনি নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে অধ্যয়নকালীন সময়ে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে দর্শনের অধ্যাপক সুধেন্দু চক্রবর্তীর বক্তব্য শ্রবণ করে ভীষণভাবে আলোড়িত হন। তখনই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, জীবনে হতে হলে কলেজের অধ্যাপকই হবেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়তে গিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে ড. এনামুল হকের পাণ্ডিত্য তাঁকে প্রভাবিত করে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন– ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে তিনি যা কিছু শিখেছেন, সব ড. এনামুল হকের অবদান। ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে এরকম পণ্ডিত তিনি দ্বিতীয়টি দেখেননি বলে উল্লেখ করেন। কৈশোরে ময়মনসিংহের বাউল জালাল উদ্দিন খাঁর সাহচর্য তাকে সমৃদ্ধ করেছে বলে মন্তব্য করেন। পিতার পেশায় ভাটার টান হওয়ায় তিনি স্কুলজীবনে দোকানদারিও করেছেন। পেট চালানোর পাশাপাশি দোকানে বসে বই পড়াই ছিল দোকানদারি করার আরেক উদ্দেশ্য। ময়মনসিংহের ‘নয়াজামানা পুঁথিঘর’ লাইব্রেরিটিও তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। তাঁর প্রখ্যাত ছাত্রদের একজন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
‘সব পাওয়ার মন্ত্র’ নাটকের বক্তব্যের সাথে তাঁর পাকিস্তানের ভূতদর্শন’ গ্রন্থের একটি বক্তব্যের সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি লিখেছেন– “জনগণের সংগ্রামের ফলে নানা ঘটনার পরম্পরার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রটির মূল কর্তৃত্ব নব্বই–পঁচানব্বই শতাংশ নাগরিকের করায়ত্ব হয়নি। বিচিত্রবিধ পন্থায় বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিতে মালিকানা লাভের বদৌলতে শক্তিমদমত্ত হয়ে উঠেছে যারা, সংখ্যায় নিতান্ত লঘু হলেও সমাজে ও রাষ্ট্রে কর্তৃত্বশীল তো এরাই। এদের বিপরীতে যাদের অবস্থান, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেদিন কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠবে, দেশে কোনো শোষকগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকবে না যেদিন… সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের প্রভাব বলয় থেকে দেশটির মুক্তি ঘটবে যেদিন; সেদিনই স্বাধীনতার অমৃত ফল পৌঁছে যাবে সকলের ঘরে ঘরে।”
যতীন সরকারের নাটক ‘সব পাওয়ার মন্ত্রে’র বক্তব্য আর তাঁর ‘পাকিস্তানের ভূতদর্শন’ গ্রন্থের উপর্যুক্ত বক্তব্যের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তব্যে। গত ৪ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে ‘গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে প্রয়াত বাঙালি মনীষী ড. আনিসুজ্জামানকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন, “বছর দশেক আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে বর্তমান সরকার প্রধানের শিক্ষক ও অতি নিকটজন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক স্বপ্ন অর্জিত হয়নি’। খুব সম্ভব সে সময় দেশে অব্যাহত দুর্নীতির চক্রবৃদ্ধি দেখে গভীর দুঃখ থেকেই তিনি কথাগুলো বলেছিলেন।” আবার বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও ইমেরিটাস প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গত ২ আগস্ট ২০২৪ –এ ডেইলি স্টার বাংলা পোর্টালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না, স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এই রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। বুর্জোয়ারা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে, হবে। আমাদের এখানকার বুর্জোয়ারা বেশি খারাপ। এইখানে পুঁজিবাদ যে ফ্যাসিবাদের আকার ধারণ করেছে, তা না থামার কারণ, বলার কেউ নেই।” গল্পে ‘ও রাজা তুই ন্যাংটা’ বলতে হয়েছে একটি শিশুকেই। এতো এতো বিজ্ঞ ও পরিণত বয়সী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও একটি শিশুই রাজার ভুল ভেঙ্গে দেওয়ার ভূমিকাটি পালন করল। আমাদের এই ভূখণ্ডে কালে কালে কিশোর ও সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ অনতিতরুণগণই সেই মোক্ষম কাজটি করেছে বা দায়িত্বটি পালন করেছে। সেটা বায়ান্নতে, ঊনসত্তরে, একাত্তরে, নব্বইয়ের গণ–আন্দোলনে ও পরবর্তীতে গণজাগরণে; ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’ নাটকে যেমন সুমনা ও তার দলবল ভূমিকাটি পালন করেছে।
বছর দুয়েক আগে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে যতীন সরকার বলেছেন– আমি ২০১৮ সালের দিকেই মারা গেছি। এখন জীবিত আছি, বেঁচে নেই। কেননা, ২০১৮ সালের পর আমি আর কিছু লিখতে পারছি না। রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন বেঁচে ছিলেন। বেঁচে থাকা আর জীবিত থাকা এক নয়। রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বেঁচে মারা গেছেন। কিন্তু তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। মানে সক্রিয় ছিলেন, সৃষ্টিশীল ছিলেন। আর আমার ছিয়াশি বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে; আমি বেঁচে নেই, জীবিত আছি মাত্র। প্রকৃত একজন সৃজনশীল ও মননশীল ব্যক্তির পক্ষেই এরকম বক্তব্য প্রদান সম্ভব।
যতীন সরকারের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমান নেত্রকোনা জেলা) কেন্দুয়া উপজেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা হোমিও চিকিৎসক জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মাতা সুগৃহিণী বিমলাবালা সরকার। তাঁর স্ত্রী কানন সরকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, তিনিও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। তাঁর দুই সন্তান; পুত্র সুমন সরকার ও কন্যা সুদীপ্তা সরকার। তাঁর নাতি–নাতনি পাঁচজন। যতীন সরকারের ডাকনাম শান্তি। এই নামে তাঁকে শৈশব–কৈশোরে ডাকা হতো। মানুষের অন্তরে ও জীবনে শান্তি আনয়নে আজীবন সৃজন–মনন ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মে নিয়োজিত যতীন সরকারের জন্ম তারিখ ১৮ আগস্ট ১৯৩৬। জীবনের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আপনাকে জানাই নিরন্তর শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা এবং টুপিখোলা অভিবাদন।
তথ্যসূত্র : ১. ‘সব পাওয়ার মন্ত্র’, যতীন সরকার; কথাপ্রকাশ, ঢাকা। ২. স্বপন ধর সম্পাদিত ‘বিদ্যাব্রতী যতীন সরকার’; ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা। ৩. আসাদুজ্জামান নূরের অনুষ্ঠান ‘বেলা অবেলা সারাবেলা’; দেশ টিভি। ৪. নিউজ পোর্টাল ডেইলি স্টার বাংলা। ৫. গুগল সার্চ ইঞ্জিন।
লেখক: নাট্যকর্মী ও শিক্ষক; সম্পাদক, নাট্যমঞ্চ