সান্ধ্য আইন মূলত নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বিশেষ কিছু কার্যকলাপ স্থগিত করার আইন। বর্তমানে বহুল পরিচিত শব্দ সান্ধ্য আইন। তবে সন্ধ্যার পরে বিশেষ কার্যকলাপ স্থগিত করা হচ্ছে কেবল নারীদের ক্ষেত্রে। তাই হয়তো প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক সান্ধ্য আইন কি–কেন–কার জন্যে, অথবা কোন বিশেষ কার্যকলাপের কথা বলছে সান্ধ্য আইনে? সান্ধ্য আইনের প্রয়োগ আদতে কতটা বৈধ? নাকি পুরুষতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার বর্বর ও বাস্তব প্রয়োগই সান্ধ্য আইন?
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য আইনের প্রয়োগ এ–লেখার সঞ্চার করে। সামপ্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগে কর্তৃপক্ষের প্রথম পদক্ষেপ ছিলো ‘সান্ধ্য আইন’। যার অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা নামলে নারী শিক্ষার্থীরা চলাফেরা করতে পারবে না, রাত দশটার ভেতর হলে ফিরে যেতে হবে, সঠিক সময়ে হলে না ফিরলে অভিভাবককে ডাকাসহ মুচলেকা নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের এক্ষেত্রে বাহবা দিতে হয়, কেননা অবশেষে তারা আসামীদের গ্রেফতার করতে বাধ্য করেছে। সান্ধ্য আইনকেও শিথিল করবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কেন এ–পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিলো? কেবল কি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়? দিন কয়েক আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হেনস্তার অভিযোগেও এমন পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ যেখানে সাম্যের পথে হওয়ার কথা সেখানে সন্ধ্যার ভেতর একজন শিক্ষার্থীকে ঘরে ফিরে যেতে বলছে কেননা সে সন্ধ্যার পর সুরক্ষিত নয়। তাহলে কাদের কাছে তারা সুরক্ষা চাচ্ছে বা বিপরীতে কারা ভয়ানক স্থানে আছেন? যাদেরকে ভয় করে সন্ধ্যাতেই ঘরে ঢুকে যাওয়ার আদেশ? এখন আসামীদেরকে শাস্তির আওতায় না এনে খুব সহজেই সান্ধ্য আইনের সুযোগ কেন নিতে চায় কর্তৃপক্ষ? বিশ্ববিদ্যালয়ের গোঁড়ায় যারা বসে আছেন তারা সবক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকই ছিলো। সমান প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ে, মেধা তালিকায় টিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেও সমান সুবিধা বা অধিকার পান না নারী শিক্ষার্থীরা।
সান্ধ্য আইন নিয়ে কথা বললে অনেকে প্রশ্ন করেন, নারীরা কি রাত–বিরাতে বাইরে থাকার জন্যে এত মরিয়া হয়ে উঠেছে? এর সবচেয়ে সুন্দর উত্তর পেয়েছিলাম, আন্দোলনেই। আমাদের মা বাবাকে নিশ্চয় আমরা সময় বেঁধে দিই না বাসায় ফেরার কিন্তু চাকরীজীবী মা–বাবা ঠিকই কাজ সেরে বাড়ি ফেরেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী টিউশন করায় না হয় কোনো না কোনো কাজের সাথে জড়িত। সারাদিন ক্লাস করে, টিউশন করে বাড়ি ফিরে আরাম করতে নিশ্চয় সকলে চায়। আর যদি হলই হয় শিক্ষার্থীর স্থান তখন ভোগান্তি দ্বিগুন, কেননা এসে রান্না করে খাওয়া অথবা ডাইনিংয়ের খাবার পাওয়ার আশঙ্কা তাকে মরিয়া করে তোলে। কিন্তু এসব তুচ্ছ যুক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে কখনো দেখিনি ছেলেদের হলে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে তালা দিতে। ছেলেদের ভাল’র জন্যে কখনও তাদেরকে সঠিক সময়েও বাড়ি ফিরতে হলো না। তবে কি ‘ছেলের ভাল’ প্রশাসন চায় না? নাকি সান্ধ্য আইনের মাধ্যমে ‘ ‘কেবল নারী’ বলেই নারীকে বন্দী করার প্রয়াস? বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে উন্মুক্ত প্রান্তর হওয়ার কথা সেখানে তারাই ‘প্রভু’র স্থানে বসে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ নারী শিক্ষককে বলতে শুনেছিলাম, পড়ালেখা না করে কেবল আন্দোলন করে রাতে বাইরে আড্ডা দিতে চাইলেই হবে? আরেক শিক্ষকও সমসুরে বলেছিলেন, নারী শিক্ষার্থীরা সকালে ক্লাসে আসতেও নাকি পারছে না, রাতবিরাতে বাইরে ঘোরাঘুরির ফলে। তাহলে স্পষ্ট নারী–পুরুষ আলাদা করার আর চেষ্টা করে লাভ নেই কেননা উভয়ের মস্তিষ্কে পুরুষতান্ত্রিকতা ছড়িয়ে পড়েছে। যে নারী শিক্ষক এমন বলছে তিনিও চাকরিই করেন, তারও হয়তো কাজের চাপে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে এখনও যদি অরুচিকর, বোরিং, মানসম্মত নয় এমন শিক্ষা দিয়ে রাতে কেবল নারীর বাইরে থাকাকে দোষী করা হয় তাহলে এত ডক্টরেট, উচ্চশিক্ষা আর শিক্ষক দিয়ে আমরা কি করব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘটনা আশা করি লেখার যৌক্তিকতা হারাবে না। সামপ্রতিক সময়ে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ফটোশ্যুট করাকে ‘খারাপ/পর্নগ্রাফির’ আওতায় ফেলেছেন স্বয়ং একজন নারী শিক্ষক। তিনি এমন আচরণ আর না করার জন্যে মুচলেকা নিয়েছেন এবং ফটোগ্রাফারের ক্যামেরা বাজেয়াপ্ত করেছেন সাথে ভুক্তভোগীদের মা–বাবকেও হেনস্তা করেছেন।
এতসব দিয়ে আশা করি বোঝার বাকি থাকে না যে, সান্ধ্য আইন মূলত নারীকে দোষী করে। সান্ধ্য আইনের পদক্ষেপ স্পষ্ট বলে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয় নারীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেননা নারীর অবাধে ঘুরে বেড়ানো, স্বেচ্ছায় কর্ম, পোশাককেই হেনস্থার জন্যে দায়ী করছে তারা। এখানে নারীর অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ।
সান্ধ্য আইনের সংজ্ঞাতে যে বিশেষ কার্যকলাপকে নিষেধ করেছে তার তালিকা কি? তালিকাতে কি কেবল নারীকে সন্ধ্যার ভেতর ঘরে ঢুকিয়ে রাখা, নারীর চলাফেরাতে সময়সূচি দেওয়া হয়েছে? কোনও অবস্থাতেই নারীকে হেনস্থা করা যাবে না, নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে স্পর্শ করা যাবে না, ধর্ষণ করা অন্যায় এসবের আইন কি কখনো প্রশাসন করেছে?
সন্ধ্যার পর নারী ঘরে থাকলে আদতে যদি সব সমাধান হয়ে যেত দিন দুপুরে সেসব হেনস্থা–ধর্ষণ, বাসে অযাচিত হাত তাদের তালিকা আর না করা উত্তম। সন্ধ্যার পর পৃথিবীর কোনও কার্যক্রম থেমে থাকে না। যদি থেমে থাকে তাহলে প্রসব করা মায়ের সন্ধ্যার পরে ব্যথা ওঠা বারণ। হলে থাকা নারী শিক্ষার্থীদের সন্ধ্যার পরে অসুস্থ হওয়া বারণ। হুট করে সন্ধ্যার পরে মাসিকের সরঞ্জাম না থাকলে রক্তে হল ভাসিয়ে দেওয়াও বারণ। যেসব নারী শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস থেকে দূরে চাকরি বা টিউশন করে চলেন তারাও রাতে বাইরে থাকবে বা না খেয়ে হলের ভেতরই মরে যাবে। পৃথিবী থেমে থাকেনি, কোথাও কোনও কাজের বিরতি নেই কেবল নারীরাই সন্ধ্যার পরে বাইরে গেলে হেনস্তা হবে কেন?
আমরা জানি বেশিরভাগ হেনস্থার অভিযোগে আসামীরা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী। আর ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তথাকথিত সে পুরুষ সমাজ যারা ক্ষমতার বলে নারীকে হেনস্থা করার অধিকার কিনে নিয়েছে। ক্ষমতার প্রয়োগ তারা নারীর উপরে করছেন কারণ তারা ভাবছেন নারী তো আদিকাল থেকেই নরম বস্তু যাকে ইচ্ছেমতো বাঁকানো যাবে। ভেবে দেখুন, প্রশাসন আমাদেরকে যে ক্ষমতা দেখাচ্ছে তারাও ক্ষমতার চাপে বেঁকে বসেছেন। তাই আসামীর দিকে নজর না দিয়ে দ্রুত নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার নামে বন্দী করছেন।
এতসবের মাঝে যখন নারী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করছে তাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে বড় বড় ঝড়ের। যারা বুঝে যাচ্ছেন ক্ষমতার লড়াইয়ে জিততে হবে তারাও সুযোগে নারীকেই দোষারোপ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এসবের চলমান প্রয়াসে সবাইকে পিষে মরতে হয়। আধুনিকায়নের যুগে কেউ আর দমে থাকবে না। সান্ধ্য আইনের ফলে নিজেদের মস্তিষ্কের অন্ধকারই তার দর্পণ। কিন্তু সবকিছু বন্দী করলেও বিবেককে কীভাবে বন্দি করবেন? তাই সান্ধ্য আইন তখনই হাতিয়ার হয় যখন সন্ধ্যা নামে মস্তিষ্কে।