ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবময় মাস। এই তিন মাস আমরা আমাদের জাতীয় চেতনাকে সমুন্নত রেখে এবং ঐতিহ্যকে লালন করার প্রয়াসে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করি। এই সমস্ত কর্মসূচীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘বই মেলা’। বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সারা দেশব্যাপী চলে বই মেলার আয়োজন। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যেন নতুন রূপে আবির্ভাব ঘটে। বিশেষ করে ভাষার মাসে বই মেলার অর্থ হচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গর্ব নিয়ে এই বাংলা ভাষা যে কত সমৃদ্ধ ও সুমধুর তার জয়গান করার উদ্দেশ্যেই বই মেলার আয়োজন। আমাদের সুদূর অতীতের সব ইতিহাস ও সংস্কৃতি এই বই মেলায় ক্ষণে ক্ষণে ফুটে উঠে ও আমরা বই মেলার আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের দৃঢ় মনোবলের প্রকাশ ঘটায়। সকল প্রকার অন্ধকার গোঁড়ামী কুসংস্কার দূর করে একটি আলোকিত সমাজ নির্মাণে সবাই একতাবদ্ধ হই। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য চলে প্রচার–প্রচারণা।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বই মেলা উদ্বোধন করতে এসে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, সবাই যেন বই পড়ার জন্য আগ্রহী হন। তিনি সবার প্রতি আহ্বান করে, বই মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করে। এক সময় বই বিনোদনের মাধ্যম ছিল। উপহারের উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ ছিল। পুরস্কারের একমাত্র পছন্দের জিনিস ছিল। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আজকাল ছেলেমেয়েরা বই তেমন পড়ে না। বিনোদনের অন্য মাধ্যমগুলোর প্রতি যে প্রবল আগ্রহ দেখা যায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে, সেই আগ্রহ বই এর মধ্যে নেই। তারা নিজেদের নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকে। আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার সমৃদ্ধশালী ভাণ্ডার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই দুর্বল। তাইতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শৈশবের সেই মধুময় স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, তার সেই শৈশবের দিনগুলো আজো তাঁকে নাড়া দেয়। তখন তিনি বই মেলার নতুন বইয়ের গন্ধে বার বার ছুটে আসতেন। সকল শিক্ষার্থীকে বইকে নিজের ও দেশ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করার আহবান জানান। তিনি বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন বিপথে চলে যাচ্ছে। তাদের সেই ভুল পথ থেকে বিরত রাখা যায় কেবল সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে। লেখাপড়া ও সংস্কৃতি চর্চা যত বেশি হবে, ততই তারা ভালো পথে চলে আসবে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখন হয়তো বই মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখা ও কেনার আনন্দ উপভোগ সম্ভব নয়। তবুও মনের খোরাকটুকু এখনো এই বই মেলার সাথে সম্পৃক্ত। সত্যিকার অর্থে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম এক অজানা আনন্দে বিভোর। তাদের মনমানসিকতা যেন একটি নিদিষ্ট বিত্তে আবদ্ধ। প্রযুক্তির যুগে তাদের সকল চিন্তা–চেতনায় বিরাজ করছে , ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার ইত্যাদি ইত্যাদি যা তাদের মধ্যে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ জোগার করছে। মনের গভীরে গিয়ে কোন ধরণের প্রভাব ফেলছে না। নতুনত্বের নেশায় বিভোর এই প্রজন্ম প্রাধান্য দিচ্ছে প্রযুক্তির সাথে জড়িত বিনোদনকে। প্রযুক্তির উপকারি দিকগুলোর চেয়ে অপকারিগুলোকেই বেশি বেছে নিচ্ছে। শখ বলতে তেমন কিছু নেই। মোবাইল আর ফাস্ট ফুডের দোকানে খেতে যাওয়ায় যেন প্রধান শখ। এক সময় শিক্ষার্থীরা শখের বসে নানা ধরণের জিনিসের প্রতি আগ্রহী ছিল। বাগান করা, ষ্ট্যাম্প ও ডাক টিকেট সংগ্রহ করা, বিভিন্ন ধরনের কয়েন সংগ্রহ করে নিজেদের সহপাঠীদের সাথে প্রতিযোগিতায় আনন্দ পেত।
দেশের জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার নাম বলতে বললেও তারা নিশ্চুপ থাকে। ম্যাগাজিন, বাংলা পুরানো সিমেনা, টিভির বাংলা চ্যানেলের নামও তারা তেমন জানে না। বই মেলা ও বই প্রসংজ্ঞে আলোচনার সাথে সাথে আমাদের নতুন প্রজন্মের চাওয়া পাওয়ার দিকগুলোও বিশেষ গুরুত্ব রাখে। এক সময় স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচী ছিল অনেক সীমিত পড়ালেখার ধরণও ছিল অনেকটা বিনোদনমুখী। পড়ালেখার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা, ক্রীড়া, গাইড, বি.এন.সি.সি এর কর্মতৎপরতা ছিল ব্যাপক। সকল ছাত্রছাত্রী এক ধরণের প্রতিযোগিতার মনোভাবে অংশগ্রহণ করত। প্রাইভেট টিউটর, কোচিং ইত্যাদিও ছিল সীমিত। অভিভাবক ও স্কুল শিক্ষকদের পাঠদানের উপর নির্ভর করে পড়ালেখা চালিয়ে যেত। কিন্তু এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। অভিভাবকরাও সেই ছোট বয়স থেকে বাচ্চাদের হাতে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তুলে দেয়। অপ্রয়োজনীয় বলছি কারণ জীবনধর্মী বিষয় থেকে আলাদা হয়ে যুগের তালে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অনেক সময় স্বীয় অস্তিত্বের সাথে জড়িত বিষয়গুলোকে অবহেলা করে। সময় ও প্রয়োজনে মানুষ অনেক সময় দ্রুত প্রতিযোগিতার শিকারে পড়ে অতীতকে ভুলে শিকড় থেকে অনেক দূরে সরে যায়। তাইতো আজকাল ছেলেমেয়েরা আমাদের ঐতিহ্যময় ও গৌরবময় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আনন্দ খুঁজে পায় না। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আহসান হাবীব যারা গত হয়েছেন তাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। হয়ত পাঠ্যসূচীতে থাকায় কবিগুরু ও বিদ্রোহী কবি সম্পর্কে অল্প কিছু জানে। কিন্তু আরো অনেক বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকরা যারা এই বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে তাদের সম্পর্কে খুবই কম জানে ও বোঝে। আমাদের সোনালী দিনের সমৃদ্ধ লোকজ ও আধুনিক গান, বাংলা সিনেমার বিখ্যাত গানগুলো, ঐতিহ্যবাহী– যাত্রাপালা সর্ম্পকে তাদের কোন আগ্রহ নেই। ভাল ভাল বই ও শিশু সাহিত্যের বিষয়েও তারা তেমন আকৃষ্ট হয় না।
আমাদের ছেলে–মেয়েরা কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে লেখা–পড়া করে। তবে ধরণটা অনেক ভিন্ন। অধিকাংশ ছাত্র–ছাত্রী লেখাপড়ার বিষয়টিকে একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের ভিতর আবদ্ধ রেখেছে। অর্থাৎ পড়ালেখা করছে ঠিকই; কিন্তু শুরু করার আগে ও পরে যে হারে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাতে কতটুকু অর্জন সম্ভব তা ভাবার বিষয়। টিচার আসার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তারা মোবাইল নিয়ে অনেক বেশী ব্যস্ত থাকে। আবার টিচার যাওয়ার পর পরই সেই একই অবস্থা। টিচারের জন্য অপেক্ষার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত পড়ালেখার পূর্ব প্রস্তুতি কতটুকু নেয় এবং টিচার যাওয়ার পর কতটুকু বোধগম্য হয়েছে এই বিষয়টি অভিভাবক মহলের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যেন একজন প্রাইভেট টিচার যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণই তাদের পড়ালেখা চলে। খুব কম শিক্ষার্থীই নিজ প্রয়োজন ও গরজে পড়ালেখার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এখানে উল্লেখ্য, অনেক প্রস্ততির পর পরীক্ষার হলে লিখে এসেই আবার মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পড়ার বিষয়টি দীর্ঘ–মেয়াদি প্রভাব ফেলে না। এই হল বর্তমান শিক্ষার্থীদের বাস্তব অবস্থা। এর বাহিরে গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ছড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাদের কোন আগ্রহ নেই। অথচ এক একটা বইয়ের চরিত্রগুলো আমাদের মাঝ থেকে নেওয়া বাস্তব চিত্র। ই–বুকের মাধ্যমে অনেকেই বই পড়ে কিন্তু এক একটি বই এবং এর প্রতিটি পাতার সাথে জড়িয়ে আছে লেখক, প্রকাশক ও অন্যান্যদের কষ্ঠের চিহ্ন। এখানে উল্লেখ্য, ছাত্র–ছাত্রীদের বই এর প্রতি আগ্রহী এবং সংস্কৃতিমনা করে তুলতে সরকার এক সময় ফেসবুক বন্ধের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার করে কখনো শিক্ষার্থীদের উৎকর্ষ সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রের পাশাপাশি অভিভাবক, বড় ভাই–বোন, পাড়াপ্রতিবেশী ও শিক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের বই এর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে, বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করতে প্রথম আলো ‘বাংলা উৎসব’ নামে একটি বিশেষ আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাষা চর্চা নিয়ে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাকে শুদ্ধভাবে চর্চা করার জন্য বার বার তাগিদের পাশাপাশি তাদের মেধার মূল্যায়নে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রসংশার দাবিদার। তাছাড়া বর্তমানে প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যম প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সুযোগ পাবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে জীবনকে সুন্দর ও সাবলীলভাবে গড়ে তুলতে পারে সেই ব্যাপারে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বাস্তব ও জীবনমূখী শিক্ষা অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের পথ আরো সুগম করতে সাহায্য করবে। আমাদের বাচ্চারা কী করে ও কী চায়, এই ভাবনার আগে আমরা (অভিভাবকরা) তাদেরকে কী দিতে পেরেছি, কী দেওয়া দরকার এবং কোন পথে পরিচালিত করছি তাই ভাবনার প্রধান বিষয়। আমাদের চাওয়া ও পাওয়ার উপরই তাদের জীবন যাত্রা পরিচালিত হয়। তাই প্রথমে আমাদেরকে ইতিবাচক হতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ,
ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম












