মোংলা বন্দর ও দেশের অর্থনীতি

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

হাতে গোনা কয়েকটি পণ্য আমদানির উপর ভিত্তি করে যে একটি বন্দর কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো মোংলা বন্দর। গত কয়েক বছরে এলপিজি গ্যাস ও গাড়ি আমদানির উপর ভিত্তি করে বন্দরটি দেশের মোট আমদানির ১০% হিস্যা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। মোংলা বন্দর এলাকায় পশুর নদের তীরে দুই কি. মি. এলাকা জুড়ে এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্টের অবস্থান। দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যারা এলপিজি ব্যবসায়ে নিয়োজিত, তাদের প্রায় সবাই এখানে এলপিজি কারখানা স্থাপন করেছে। গত ৭৮ বছরে মোংলা বন্দর এলাকায় এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। জানা যায়, মোংলা বন্দর দিয়ে এলপিজিবাহী ছোট জাহাজ আনা বেশ সহজ। এখানে প্রতিটি প্ল্যান্টের নিজস্ব জেটি থাকায় সরাসরি প্ল্যান্টে এলপিজি সরবরাহ করা যায়। শুল্কায়নসহ সব আনুষ্ঠানিকতা প্লান্টেই সারা হয়। জাহাজ থেকে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে কোম্পানির বিশাল ডিম্বাকৃতির বয়লারে এলপিজি সরবরাহ করা হয়। একই সঙ্গে সেই বয়লার থেকে চিকন পাইপের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাসাবাড়িতে ব্যবহার্য সিলিন্ডারে গ্যাস ঢুকানো হয়। এভাবে প্রতি মিনিটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২৬টি সিলিন্ডারে এলপিজি ভরা হয়। এরপর এলপিজি ভর্তি সিলিন্ডারগুলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। কারখানার কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের অনেকেই বলেন, মোংলা এখন দেশের এলপিজির রাজধানী হয়ে গেছে। জানা যায়, দেশে প্রতিবছর ১৫ লাখ টনের মতো এলপিজি আমদানি হয়। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ আমদানি হয় মোংলা বন্দর দিয়ে। বলা যায়, মোংলা বন্দর সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে এলপিজি আমদানি। কারণ বর্তমানে এখানে যত জাহাজ ভেড়ে, তার ৪০% এর বেশি এলপিজিবাহী। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত ২০২২২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৮২৭টি জাহাজ এসেছে। এর মধ্যে ৩৬৩টি জাহাজে শুধু এলপিজি আনা হয়েছে।

১৯৫০ সালে চালনা বন্দর নামে প্রথম মোংলা বন্দরের গোড়াপত্তন হয়। ঐ বছরের ১১ ডিসেম্বর পশুর নদের জয়মণির ঘোল এলাকায় দ্য সিটি অব লিয়নস নামে জাহাজ নোঙরের মাধ্যমে বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত চালনায় এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৫৪ সালে খুলনা শহর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে পশুর নদের পূর্ব তীরে মোংলা চ্যানেলে বন্দরটির কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়।

সমপ্রতি পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে মোংলা বন্দরের ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। কারণ এই বন্দরটি ঢাকা থেকে দেশের সবচেয়ে কাছের সমুদ্র বন্দর। যার দূরত্ব ঢাকা থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার, যা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮০ কি. মি. কম দূরত্বে অবস্থিত। ফলে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের মনোনীত শিপিং এজেন্ট নিয়োগ শুরু করেছে এই বন্দরে। দেশের বৃহৎ শিপিং কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আগ্রহ দেখিয়ে লজিস্টিক সাপোর্ট চেয়েছে। তাদের চাওয়া পূরণ হলে দেশের আমদানি, বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহ ভাগ কাজ মোংলায় স্থানান্তরিত হবে বলে জানা গেছে। ফলে অদূর ভবিষতে চট্টগ্রামের মতো এই বন্দর থেকেও ইউরোপে সরাসরি কনটেইনারবাহী জাহাজ চালু হবে। স্বাধীনতার পর সমুদ্রপথের বাণিজ্য বলতে ছিল চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর। শুরুতে বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় অংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন হতো। ১৯৭৩৭৪ অর্থবছরে মোট আমদানি রপ্তানির ২৮% পরিবহন হতো মোংলা বন্দর দিয়ে আর ৭২% পরিবহন হতো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এরপর অনুন্নত যোগাযোগের কারণে মোংলা বন্দরের হিস্যা কমতে থাকে, বাড়তে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের চাহিদা ও কর্মচাঞ্চল্য। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, পায়রা বন্দর চালুর আগে ২০১৪১৫ অর্থবছরে সমুদ্রপথে মোট ৫ কোটি ২৫ লাখ টন পণ্য পরিবহন করা হয়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন করা হয় ৯২% বা ৪ কোটি ৮১ লাখ টন পণ্য। মোংলা বন্দর দিয়ে পরিবহন করা হয় ৪৪ লাখ টন বা ৮%। আর ২০২২২৩ অর্থ বছরে মোংলা বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন হয় ১ কোটি ১২ লাখ টন।যা মোট সমুদ্র পথে পরিবহনের ১০%।একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পরিবহন করা হয় ১০ কোটি টন, যা মোট পণ্য পরিবহনের ৮৭%

অন্যদিকে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালে। ২০১৬ সালে সাগরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে স্থানান্তরের মাধ্যমে শুরু হয় এই বন্দরের কার্যক্রম। বন্দরটিতে এখনো পণ্য উঠা নামার মতো সুবিধা তৈরি হয়নি। একটি বহুমুখী টার্মিনাল নির্মাণ শেষের পথে, যা এ বছর আংশিক চালু হতে পারে বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।

টার্মিনাল না হলেও এখন বন্দরটির বহির্নোঙরে পণ্য স্থানান্তরের কার্যক্রম চলছে। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি হচ্ছে এ বন্দরের মাধ্যমে।এই কয়লা আমদানির মাধ্যমে মোট সমুদ্রপথের বাণিজ্যে ৩% (৩৮ লাখ টন) অংশীদারি নিয়েছে বন্দরটি। এ বন্দর দিয়ে খোলা পণ্য পরিবহন বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এ বন্দরের মাধ্যমে বহির্নোঙরে পণ্য স্থানান্তরের পর অভ্যন্তরীণ নদীপথে ঢাকা অঞ্চলে সহজে পরিবহন করা সম্ভব। অন্যদিকে চট্টগ্রামে খোলা পণ্য (বাল্ক কার্গো) সাগর উপকূল পাড়ি দিতে হয়, যেটি পায়রা বন্দরে দিতে হয় না।

জানা যায়, সদ্য সমাপ্ত ২০২২২৩ অর্থ বছরে মোংলা বন্দরে ভিড়া জাহাজে মূলত সরকারি সার, গম, এলপিজি, কয়লা ও সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। ঐদিকে দেশের অর্ধেকেরও বেশি (৫৫%) গাড়ি মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। আগে শুধু মোংলা দিয়ে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের পণ্য রপ্তানি হলেও এখন ঢাকা থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হচ্ছে।

মোংলা বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুনের পর পশুর নদের ইনারবারে ড্রেজিং এর প্রকল্পটি শেষ হলে স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে আট মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দর জেটিতে ভিড়তে পারবে। আর জোয়ারের সময় পানি আরও দুই মিটার বাড়লে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে ২,৫০০ কনটেইনার বাহী (,৫০০ টিইইউজ) জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারবে। এতো বড় জাহাজ এখন চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। এর ফলে মোংলা বন্দর ব্যবহারে আরো বেশি আগ্রহী হবেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মোংলা বন্দরে নানা ধরনের হ্যান্ডেলিং যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। আবার সরকারি বেসরকারি অংশীদারত্বে যে দুটি জেটি নির্মাণের কাজ চলছে, তা আগামী বছর শেষ হবে। ফলে মোংলায় আগামী দিনে পণ্য পরিবহন আরো বাড়বে। পদ্মা সেতুর পর মোংলা খুলনা রেললাইনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এই রেললাইন চালু হলে, দেশের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যবসায়ীরাও এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।

মোংলা বন্দর ব্যবহারে নেপাল ও ভুটানের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। কারণ নেপাল ও ভুটানের সবচেয়ে কাছের সমুদ্রবন্দর মোংলা। রেলপথ চালু হলে মোংলা থেকে যশোর, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও দিনাজপুর হয়ে ভারত ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল পর্যন্ত সহজেই পণ্য পরিবহন করা যাবে। অন্যদিকে মোংলা থেকে চিলাহাটি হয়ে ভারতের জলপাইগুঁড়ি পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করলে ভুটানের জন্য সহজ হবে মোংলা বন্দর ব্যবহার। তবে মোংলা বন্দর ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও ভারতের মধ্যে অবাধ যান চলাচল চুক্তি করতে হবে। আর এর ফলে এই অঞ্চলে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে মোংলা বন্দর। যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইকেলের নাটক এবং নাটকে মাইকেল
পরবর্তী নিবন্ধআত্মশুদ্ধি অর্জনে ‘উছুলে ছাবয়া’র গুরুত্ব