সমপ্রতি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ ঘোষণা করা হয়েছে। কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মত ঘোষণা নিঃসন্দেহে! কিন্তু বিচারের পরে শাস্তি যেটাই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে এই ঘোষণাতে দেশে চলমান ধর্ষণ মহোৎসবের কোন ইতরবিশেষের কিছু হবে বলে মনে হয় না। ধর্ষণের শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ হোক বা ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ হোক, সেসব রায় ঘোষণার প্রশ্নতো আসবে বিচারকার্য শেষ হবার পরে। আগে তো ধর্ষণকারীর বিচারকাজ সম্পন্ন হোক! রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিপুষ্ট ধর্ষকদের আশ্রয় -প্রশ্রয় দেয়া, ধর্ষকদের গ্রেফতারে গড়িমসি করা, বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা, ধর্ষকদের জামিনযোগ্য গ্রেফতার, ইত্যাদি কোনটাতেই কি কোন প্রভাব ফেলবে এই ঘোষণা? ধর্ষণের কয়টা মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ‘মৃত্যুদন্ড’ ঘোষণা করে ধর্ষকদের ভয় দেখানো যাবে?
ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশে আইন আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও আছে, কিন্তু তারপরেও বর্তমানে মেয়েদের বিরুদ্ধে একের পর এক ঘটেই চলেছে যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ ইত্যাদি কুকর্মগুলো। বর্তমান সময়টাতে আমাদের দেশে ‘ধর্ষণ ‘ এক ভয়ংকর মহামারীরূপে জনমানসে আতংকের সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজ হাতে নিলেই দেখা যায়, দেশের বিভিন্নস্থানে নরপিশাচের দল কি নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে অসহায় নারীদের উপর! নির্মম এই দৃশ্য কাঁদিয়ে তোলে হৃদয়কে। যত দিন যাচ্ছে ততই জনমানসে আতংক বেড়েই চলেছে।
টেলিভিশন, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস আপ, অনলাইন নিউজ সাইট, ব্লগ সাইট, ইত্যাদিতে ইদানীং শুধু ধর্ষণের খবর আর খবর! পশুশ্রেণীর এই মানুষগুলো তাদের শরীরীক্ষুধা মেটাতে গিয়ে ছাড় দিচ্ছে না কাউকেই! ৭ থেকে ৭০, সববয়সের শিশু, নারী কেউই এখন আর হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত নয়। এসব পিশাচদের কাছে, নারী মানেই একতাল মাংসপিণ্ড, শুধুই ভোগের বস্তু!
বিগত বছরগুলোর তুলনায় বর্তমানে আমাদের দেশে হঠাৎ করে ধর্ষণের হার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণের একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটা ধর্ষণ! কোনভাবেই থামানো যাচ্ছেনা এদের। একের পর এক বেড়েই চলেছে অসামাজিক, ঘৃণিত এই ছোঁয়াচে রোগটা! মানুষের মনুষ্যত্ব আজ একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেই আজ লজ্জাবোধ হয়। কিন্তু কেন আমাদের এমন সোনার দেশটা আজ ধর্ষকদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে? উত্তর একটাই। এর জন্য বহুলাংশেই দায়ী হচ্ছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে চলমান আইন আর আইনের শিথিল প্রয়োগ।
দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন ক্রাইমের ভিক্টিম বিশেষ করে ধর্ষিতাদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ গুলোর বার্ষিকী খতিয়ান দেখলেই এসময়টাতে সংঘটিত ধর্ষণগুলোর ভয়াবহতা সম্বন্ধে জানা যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে সারাদেশ থেকে ৮-১০ জন শারীরিকভাবে নির্যাতিত নারী চিকিৎসা নিতে আসে। সেই হিসেবে মাসে ২৫০-৩০০ ধর্ষিত নারী চিকিৎসা নিচ্ছে সেখানে। কিন্তু এই সংখ্যাটা কোনভাবেই বর্তমান সময়ে সংঘটিত ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা নয়! এর বাইরেও সমাজের চাপে, লোকলজ্জার ভয়ে, চুপচাপ নীরবে চোখের জল ফেলছে যে হাজার হাজার নির্যাতিত, ধর্ষিত অসহায় নারী, তারা তো মিডিয়ার অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে! ফলে তাদের কোন হিসেবই নেই সরকারের কাছে।
আইনজীবী সমিতির রিপোর্ট সহ বিভিন্ন সরকারি -বেসরকারি সংস্থার সংগৃহীত ধর্ষণসংক্রান্ত মাসিক বা বার্ষিকওয়ারী যে রিপোর্টসমূহ নিয়মিত প্রকাশিত হয় তা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু নির্ভরযোগ্য? শুধুমাত্র পত্রিকায় ছাপানো খবর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কমিটিগুলো রিপোর্ট তৈরি করে। কিন্তু বাস্তব হলো, ধর্ষণের পর নিজের বা পরিবারের মানসম্মান, লোকলজ্জার ভয়, ধর্ষকের পরিবারের হুংকার, বিভিন্ন সামাজিক চাপ ইত্যাদির জন্য মুখ বন্ধ করে ঘরের চারদেয়ালের মাঝে গুমরে মরছে অগণিত ধর্ষিত নারী।
অনেকে ধর্ষণের কারণ বলতে নারীদের স্বাধীনভাবে চলাচল, তাদের পোশাকের দিকে ইংগিত করে থাকে। এসব অবান্তর এবং হাস্যকর এই যুক্তিগুলোর মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে, উচ্ছৃংখল কিছু পুরুষের কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করাটাকে জায়েজ করে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীদের দমিয়ে রাখা। তাদের অগ্রযাত্রাকে বাধাপ্রাপ্ত করা। নারীর পোশাকই যদি ধর্ষণের কারণ হয়, তাহলে আপাদমস্তক ঢেকে রাখা মাদ্রাসাছাত্রী কেন ধর্ষিত হচ্ছে? পাঁচ বছরের অবোধ শিশু কেন ধর্ষিত হচ্ছে? কেন ধর্ষণের পর ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে কিছু বিকৃতমস্তিষ্ক পশু?
সঠিক সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্য দিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য মাঝেমধ্যে এই যে অসৎ এবং ভাঁওতাবাজির আলোচনা চালানো হয়, তাতে ধর্ষকের মনে ভয়ের পরিবর্তে আরো সাহস বেড়ে যায়। ক্রমাগত অন্যায় করতে তাই সে পিছ পা হয়না।
বর্তমানে ২ লক্ষের মত ধর্ষণমামলা ঝুলে আছে। কোনো তদন্ত নেই। এবং এর জন্য কোনরকম ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে নিত্যনতুন অপরাধ করেই চলেছে। প্রতিবছর মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩.৬৬%, আর সাজা পাচ্ছে প্রতি হাজারে ৪ জন। তার মানে সাজার হার হচ্ছে ০.৪৬%। প্রকৃত সংখ্যার নগণ্য কিছু হলেও এই যে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষণের চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের করা যে কয়েক হাজার মামলা রয়েছে, তার ক’টার রায় ঘোষণা হয়েছে? আর শাস্তিই বা হয়েছে ক’জনের? তাহলে বাকীগুলো কি মিথ্যা মামলা ছিল? ধর্ষিতার ঘটনা মিথ্যা ছিল নাকি ধর্ষক নিরপরাধী ছিল?
সবই সঠিক ছিল, শুধু সঠিক নয় আমাদের দেশের চলমান আইন আর তার তদন্ত প্রয়োগ ইত্যাদি। আইনের ত্রুটি থাকায় আজ স্বাধীন দেশের বসবাসকারী হয়েও নারীদের চলাচলে স্বাধীনতা নেই। প্রতিক্ষণে নিজেদের সম্ভ্রম নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তারা।
কোন সমাজে বাস করি আমরা? যেখানে নারী মানেই ভোগের বস্তু! ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই আজ মেয়েদের। স্বামীর পাশে স্ত্রীর নিরাপত্তা নেই, মাতাপিতার কোলে থেকেও নিরাপত্তা নেই তাদের কন্যাসন্তানটির। চারদেয়ালের মাঝে থেকেও আজ বিপদ মুক্ত নয় নারী!
কিন্তু এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না। নারীদের ওপর অবিরাম ঘটে চলা এই পাশবিকতার বিরূদ্ধে সোচ্চার হোন, আওয়াজ তুলুন সকলে। মনে রাখতে হবে, আমি, আপনি, আমরা কেউই এই সমাজের দূষণের বাইরে নেই। তাই অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে হবে সমস্বরে।
সরকারপক্ষ, বিরোধীপক্ষ, এসব নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে জাতীয় এই সমস্যাটা নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনার মধ্য দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশকে এই ভয়ংকর মহামারীর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। এজন্য চলমান আইন সংশোধন অত্যন্ত জরুরি! সরকারের উচিত কোন ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা না করে বরং তার তাতক্ষণিক বিচার করা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার সম্পাদন করতে যা কিছু আইন সংস্কার করতে হয় তা করাটা সরকারের দায়িত্ব। ক্ষেত্রবিশেষে বিচারকদেরকেও সততার সাথে আইনের কাজ করতে চাপ দিতে হবে, যাতে অপরাধী গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরতে না পারে।
নরপশুদের কবল থেকে আমাদের মা-বোন-সন্তানদের সম্ভ্রম রক্ষা করার দায়িত্ব আমার, আপনার, সকলেরই। তাই শুধুমাত্র সরকারের মুখের দিকে না তাকিয়ে থেকে প্রত্যেক নাগরিকের উচিত ধর্ষণ ঠেকাতে নিজেদেরই কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া।
‘ধর্ষণ’ নামক সমাজের এই বিষফোঁড়াটা সমূলে উৎপাটন করতে হলে প্রশাসন, আইনবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেমন অপরিসীম দায়িত্ব রয়েছে, পাশাপাশি জনগণেরও রয়েছে কিছু কর্তব্য। বিশেষ করে মেয়েদের আরো বহুগুণে সচেতন হতে হবে। অকেজো মেয়েলি লজ্জ্বার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সাহসী ও প্রতিবাদী হতে হবে।
যে অমানুষটা আজ ধর্ষণ করার মত দুঃসাহস দেখালো সে নিশ্চয় এর আগে ভিড় বাসে কোন না কোন মেয়েকে অশ্লীলভাবে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখিয়েছে! কিন্ত নিশ্চিতভাবেই মেয়েটির কাছ থেকে তাকে কোন প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়নি। পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া মেয়েটিকে নিশ্চয় কোন না কোন সময় বখাটেদের ছুঁড়ে দেয়া অশ্লীল বাক্য শুনতে হয়েছে। কিন্তু নিজেকে অসহায় ভেবে সে কোন প্রতিবাদ করার সাহস দেখায়নি। এসব ছোটখাটো ঘটনাগুলো থেকেই ধর্ষকদের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, এই মেয়েদের সাথে যা ইচ্ছা, তাই করা যায়! কারণ তাদের ঠেকানোর মত কোন ক্ষমতা নেই। ফলাফলে কি হয়? ভদ্রমেয়ের মত চুপচাপ সয়ে গিয়েও নিজের সর্বনাশটা ঠেকাতে পারে না মেয়েগুলো।
তাই বলি কি, প্রতিবাদ করতে শিখুন মেয়েরা। আপনার কন্যাসন্তানটিকে নাচ-গান -কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি সুকুমারবৃত্তি পাঠদানের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে ক্যারাটে শেখান। মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশলগুলো শেখান। মাথানিচু করে স্কুল করতে শেখানোর চেয়ে প্রতিবাদী হতে শেখান। প্রতিবাদ করার সকল অস্ত্র তার হাতে তুলে দেন। মেয়ে যখন নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে, তার দিকে এগিয়ে আসা কালো হাতগুলো মুচড়ে ভেংগে দেয়ার সাহস দেখাবে তখন নরপশুগুলো আপনাআপনিই পিছু হটবে।
নিজেকে সাহসী ভাবুন, দেখবেন মনে সাহস আপনা থেকেই চলে এসেছে। কিছুকিছু ব্যাপারে নিজে থেকেই সাবধানী হতে হবে মেয়েদের। কোন জায়গায় গিয়ে বিপদে পড়তে পারেন, এরূপ আশংকা থাকলে আধঘন্টা আগে আপনার লোকেশন জানিয়ে পুলিশকে মেসেজ করে দিতে পারেন। ঘাবড়ে না গিয়ে ধর্ষকের চোখে ‘পীপার স্প্রে’ দিয়ে পালানো, ধারালো কিছু দিয়ে তাকে আঘাত করা, কিংবা ধর্ষকের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে তীব্র আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করে দেয়া ইত্যাদি আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থাগুলোর সাথে পরিচিত হতে হবে আপনাকে। মনে রাখবেন, আক্রান্ত হলে আপনার রক্ষাকারী কিন্তু শুধু আপনিই! সর্বোপরি নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে। ‘অন্যের ঘরের সমস্যা’ ভেবে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উপায় আর নেই। মনে রাখবেন, আজ আপনার প্রতিবেশীটার ঘরে যে বিপদটা হলো তা কিন্ত আগামীতে আপনার ঘরে হবারও ইংগিত দিয়ে গেল। তাই সবাই প্রতিবাদী হোন। গণধোলাই দিয়ে আপনার এলাকা থেকে ধর্ষকদের তাড়ান। প্রত্যেকে নিজের কন্যাসন্তানটিকে রক্ষা করার পাশাপাশি অন্যেরটাকেও রক্ষা করুন। দেখবেন, একটা সময়ে সুবাতাস বইবেই! সকলের সমবেত চেষ্টায় নিশ্চয় একদিন প্রিয় মাতৃভূমির সকল তমসা কেটে যাবে। আবারো আসবে সূর্যকরোজ্জ্বল দিন। হাসিতে উদ্ভাসিত হবে চারদিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক