প্রত্যেকের জীবনেই কিছু মূল্যবান স্মৃতি থেকে যায়, যা সময়ের সাথে ঝাপসা হয় না, মনের গভীরে সযতনে আগলে রাখা সেই টুকরো টুকরো স্মৃতি অমলিন রয়ে যায় চিরতরে।
বাবা মার স্মৃতি ঠিক তেমনটি, চোখের সামনে না থাকলেও পঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিনিয়ত মনে পড়ে বাবা মার সাথে কাটানো অমূল্য সেই সময়ের কথা। বাবাকে নিয়ে আগে কিছু মনের কথা ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছি, মূলত তাঁর পেশাগত জীবন, দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবনা–এসব নিয়ে। আজকাল খুব বেশি মনে পড়ে বাবার সাথে কাটানো দুর্লভ এবং একান্ত কিছু পারিবারিক সময়ের কথা। বাবা সবসময় চেষ্টা করতেন পরিবারের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র নিউরোসার্জন হিসেবে সম্পূর্ণ এককভাবে সেই দুরূহ দায়িত্ব পালন করার কারণে বাবার পক্ষে পরিবারকে অখণ্ড সময় দেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিলো। তবু বাবা মনে মনে চাইতেন আমাদের কোনো বিশেষ বা বড় পরীক্ষাগুলি ভালো মতন উতরে গেলে সপরিবারে ভ্রমণে বের হবার।
অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক এবং বৃত্তি পরীক্ষার পর বাবা মনস্থির করলেন আমাদের নিয়ে সার্কভুক্ত দুটি দেশ, নেপাল এবং ভারতে দুই সপ্তাহের জন্য ঘুরতে নিয়ে যাবেন।
বাবার মতন সদাব্যস্ত চিকিৎসকের জন্য দুই সপ্তাহ ছুটি মানে বিশাল ব্যাপার, যেখানে জন্ম থেকে কখনও দেখিনি বাবাকে ২–১ দিনের বেশি ছুটি নিতে। নতুন দেশ আবিষ্কারের উত্তেজনার চেয়ে রাত–দিন ২৪ ঘন্টা বাবার সান্নিধ্য পাবো, এটা ভেবেই আনন্দে ঘুম আসতোনা আমার।
বাবা যতক্ষণ আমাদের সাথে সময় কাটাতেন, তখন যেন আমাদের মতনই শিশু হয়ে যেতেন। নতুন নতুন সব জায়গা, নতুন ধরনের খাবার, বিভিন্ন রকমের জীব বৈচিত্র্য, সবকিছু বাবা ঠিক শিশুসুলভ কৌতূহল উচ্ছ্বাস নিয়ে দারুণ উপভোগ করতেন।
ভ্রমণের প্রথম দিনে দিল্লী পৌঁছে হোটেলে চেক ইন করে বাবা ম্যাপ হাতে নিয়ে পায়ে হেঁটে নতুন জায়গা খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার পর আবারো কীভাবে যেনো হোটেলে ঠিকঠাক পৌঁছে গেলেন। বাবার সাথে এ ধরনের অভিযানের ঘটনা অনেক চমকপ্রদ দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের চেয়ে বেশি আনন্দের খোরাক যোগাতো।
চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী হলেও সব বিষয়ে বাবা অগাধ জ্ঞান রাখতেন। আগ্রা এবং ফতেহপুর শিক্রীতে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি ঘুরে দেখার সময় আবিষ্কার করলাম মুঘল ইতিহাস বাবার নখদর্পণে। ইন্টারনেট প্রাক্কালযুগে বাবাকে মনে হতো জীবন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া। দিল্লী, আজমীর, আগ্রা, জয়পুর সর্বত্র ভ্রমণ করার সময় বাবা আমাদের ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিক গল্প আর ফান ফ্যাক্টস যেভাবে বিনোদনের ছলে বলতেন, তা চিরদিনের জন্য মনে গেঁথে যাবার মতন।
ভারত ভ্রমণ শেষে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিলো নেপাল। শান্ত সুন্দর ছিমছাম সাজানো গোছানো শহর কাঠমাণ্ডুতে বাবাকে আমরা যেন শতভাগ বাবা হিসেবেই পেয়ে যারপনাই খুশি। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কল নেই, রোগীদের ফোন নেই–বাবা ও যেনো পরিপূর্ণভাবে আম্মু এবং আমাদের সময় দিতে পেরে সারাক্ষণ খোশ মেজাজে হাসি ঠাট্টায় মশগুল, আর তা দেখে আমাদের খুশির সীমা ছিলো না।
তবে বাবা যে পুরোপুরি তাঁর পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। কীভাবে যেনো বাবার নেপাল যাবার খবর তাঁর কিছু প্রাক্তন নেপালী ছাত্রের মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। বাবাকে বেশ কয়েকজন ডাক্তার নেপালে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছিলেন, বাবার প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সার্বক্ষণিক খেয়াল দেখে আমি যে মনে মনে গর্ব বোধ করিনি তা না বললে ভুল বলা হবে।
নেপাল থেকে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিলো কোলকাতা, আরো বিশেষভাবে বললে কলেজ স্ট্রিট। খুব ছোটকাল থেকেই বইপড়ার অভ্যাসের বীজ বাবা আমাদের মধ্যে যেভাবে বপন করেছিলেন তাতে আমাদের বাসাটা যেনো বিবিধ গল্প উপন্যাসের বইয়ে ভরা একটা ছোট খাটো লাইব্রেরি হয়ে উঠেছিলো। বেশকিছু দুর্লভ বই তখন দেশে পাওয়া না গেলে আমরা নোট করে রাখতাম আর সেই গুপ্তধনের সন্ধানেই কলেজ স্ট্রিটে যাওয়া। বাবা–মার সাথে কোলকাতার ট্রামে চড়ে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে গিয়ে স্কুলের ব্যাকপ্যাক বোঝাই করে বই কিনে বাড়ি ফেরা–সে ছিলো যেন আমাদের সেইবারের ভ্রমণের মধুরেন সমাপয়েৎ! মনের গহীনে সেই সুখস্মৃতি চির অম্লান। বাবাকে ওভাবে ঘটা করে কী কখনো বলেছি-‘বাবা তুমি পৃথিবীর সেরা বাবা!’ আজ আকাশ পানে তাকিয়ে বারবার তা উচ্চারণ করি-‘বাবা, তুমি কী আমায় শুনতে পাও?’
লেখক : প্রফেসর ডা. এল এ কাদেরীর কন্যা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইলকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার