এবার আর হতাশা নয়। আর নয় তীরে এসে তরী ডোবা। সবকিছু ছাপিয়ে বাংলার মেয়েরা গড়েছে ইতিহাস। হিমালয়ের দেশ থেকে ছিনিয়ে এনেছে শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি। দেখিয়েছে দাপট, করেছে একের পর এক রেকর্ড। আনন্দে ভেসেছে ওরা, ভাসিয়েছে দেশবাসীকে। ১৯ বছর পর এনে দিয়েছে ট্রফি। প্রথমবারের মত নারী ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব এখন বাংলার মেয়েদের, বাংলাদেশের।
গতকাল সোমবার নেপালের রাজধানী কাটমন্ডুর রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এদিন প্রতিপক্ষ নেপালের ১১ ফুটবলারের সাথে ছিল দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং গ্যালারি ভর্তি ১৫ হাজার দর্শকের গগণবিদারী চিৎকার। তবে শেষ পর্যন্ত সব কিছুকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ নারী দল জিতে নিল সাফ ফুটবল টুর্নামেন্টের শিরোপা। গত কয় বছর ধরে তিল তিল করে নিজেদের যেভাবে গড়ে তুলেছিল সাবিনা- কৃঞ্চারা তার ফল যেন পেল গতকাল। অদম্য ইচ্ছা শক্তি থাকলে যে সফল হওয়া যায় তার বড় উদাহরণ যেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের এই জয়।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে (কি পুরুষ আর কি নারী) সব সময় সেরা ভারত। সে ভারতের কাছে হেরে বার বার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে বাংলাদেশের। ২০০৩ সালে প্রথম এবং শেষবার দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। এরপর থেকে কেবলই হতাশা আর হতাশা। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের এই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ফাইনালে উঠেছিল নারী দল। কিন্তু সেবারও হতাশ হতে হয় ভারতের কাছে হেরে। তবে এবার আর হতাশ করেনি তারা। একেবারে দাপটের সাথে প্রতাপশালী সব প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মত জিতল শিরোপা। যেখানে ভারতকেও হারিয়েছে ৩-০ গোলে।
এদিন নেপালের রাজধানী কাটমান্ডুর রঙ্গশালা স্টেডিয়ামকে সত্যিই রঙ্গশালা বানিয়ে দিয়েছিল বাংলার মেয়েরা। যে রঙ্গশালায় বাংলাদেশ কেবলই হেসেছে আর স্বাগতিক নেপালীরা চোখের জলে ভেসেছে। বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা নারী দল গতকাল বৃষ্টি ভেজা ভারি মাঠে যেন নিজেদের জান প্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলেছে। আর তাতেই একেবারে অপরাজিত থেকে শিরোপা জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করল সাবিনা-কৃঞ্চা-স্বপ্নারা। কথায় আছে ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের দেখাটা ঠিক বিজয়েই হলো।
এবারের সাফ মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ। সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিজেদের গায়ে হারের আঁচড় লাগাতো দূরের কথা, কোনো গোলই হজম করেনি। সে আত্নবিশ্বাস আর মনোবল নিয়ে খেলতে নেমেছিল ফাইনালে। তাতেও বাজিমাত। যদিও ফাইনালে একটি গোল হজম করেছে বাংলাদেশ দলের গোলরক্ষক, তবে অক্ষুন্ন রেখেছে অজেয় থাকার রেকর্ড।
তীরে এসে তরি ডুবানোর নজির বাংলাদেশের অনেক রয়েছে। শেষটা রাঙাতে না পারার হতাশায় পুড়তে হয়েছে বারবার। তাইতো মনের কোনে ভয় উুঁকি দিচ্ছিল বারবার। আরো একবার স্বপ্ন ভঙ্গ হবে না তো? কিন্তু ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’ প্রবাদের মত সবকিছুকে রাঙিয়ে দিল বাংলার সাবিনারা। হিমালয়ের চূড়ায় যেন নিয়ে গেল বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে।
ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপালও হারেনি একটি ম্যাচও। তাই লড়াইটা হবে সেয়ানে সেয়ানে সেটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু অদম্য বাংলাদেশের সামনে দাঁড়ানো যে কঠিন সেটা বেশ ভালই টের পেল স্বাগতিক নেপালের মেয়েরা। তিন তিনটি গোল হজম করতে হলো তাদের। আর তাতে স্বপ্ন ভঙ্গ হলো তাদেরই। বাংলাদেশ উড়াল লাল-সবুজের পতাকা। ১৯ বছর পর সাফের আরেকটি শিরোপা বাংলাদেশের। আর নারীরা জিতল প্রথমবারের মত।
বৃষ্টি ভেজা কর্দমাক্ত ভারী মাঠে দুই দলকেই বাড়তি বল প্রয়োগ করে খেলতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও প্রথম মিনিটেই আক্রমণে যায় বাংলাদেশ। মারিয়া মান্দার বঙের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট নেপাল গোলরক্ষক আটকালেও পুরোপুরি গ্লাভসে নিতে পারেননি। ফিরতি বলে স্বপ্নার শট কর্নারের বিনিময়ে ফেরান আঞ্জিলা থুম্বাপো সুব্বো। ৯ মিনিটে এগিয়ে যেতে পারতো বাংলাদেশ। মারিয়ার জোরালো ক্রস থেকে বঙের ভেতর বল পেয়ে যান কৃষ্ণা। কিন্তু তার শট সরাসরি যায় গোলরক্ষকের হাতে। ১৪ মিনিটে দুর্দান্ত এক গোলে দলকে এগিয়ে দেন শামসুন্নাহার। সানজিদা খাতুনের শট থেকে বল পেয়ে যান মনিকা। একজনকে কাটিয়ে তিনি ক্রস বাড়ান বঙে। শামসুন্নাহারের দারুণ এক ক্লিকে বল জড়িয়ে দেন জাল্, েউল্লাসে মাতে বাংলাদেশ শিবির। টুর্নামেন্টে নেপালের জালে এটাই প্রথম গোল। গোল শোধে মরিয়া হয়ে ওঠে নেপাল। ২৩ মিনিটে অনিতার শট ফেরান বাংলাদেশ গোলরক্ষক। ৪১ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণের উচ্ছ্বাসে মাতে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের ভুলে বল পেয়ে অধিনায়ক সাবিনা পাস দেন কৃষ্ণার উদ্দেশ্যে। বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে বল জালে পাঠান এই ফরোয়ার্ড। ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় বাংলাদেশ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই খেলায় আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে বাংলাদেশ। কিন্তু বারবার নেপাল হানা দিয়েছে বাংলাদেশের রক্ষণে। তবে সুবিধা করতে পারেনি মোটেও। কারণ গোলবারের নিচে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে ছিলেন গোলরক্ষক রুপনা। ৭০ মিনিটে গোলের দেখা পায় নেপাল। বঙের ভেতরে ফাঁকায় বল পেয়ে জোরাল কোনাকুণি শটে লক্ষ্যভেদ করেন বাসনেত। রুপনা ঝাঁপিয়ে পড়েও বলের নাগাল পাননি। টুর্নামেন্টে এই প্রথম গোল হজম করল বাংলাদেশ। ৭৭ মিনিটে ব্যবধান আরো উন্নীত করে বাংলাদেশ। সতীর্থের থ্রুু পাস ধরে একেবারে ঠান্ডা মাথায় নেপাল গোলরক্ষকের মাথার উপর দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে উল্লাসে মাতান কৃষ্ণা। আর তাতেই বাংলাদেশের জয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর ঘড়ির কাঁটা যতই গড়িয়েছে, নেপাল একটু একটু করে ম্যাচ থেকে ছিটকে গেছে। শেষ পর্যন্ত সাফে তো বটেই নেপালের বিপক্ষেও আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথম জয়ের রূপকথার গল্প লিখে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। তাইতো শেষ বাঁশি বাজার্ সাথে সাথে বাধ ভাঙ্গা জোয়োরে ভাসে বাংলাদেশ দল। পরম প্রাপ্তির আনন্দে ঝরেছে আনন্দাশ্রু। ইতিহাস রচনা করে হিমালয়ের দেশ থেকে ফিরছে সাবিনা-কৃঞ্চা-মারিয়া-স্বপ্না রানীর মত অকুতোভয় আত্ন প্রত্যয়ী বঙ্গ ললনারা।
ট্রফি জয় ছাড়াও ষষ্ঠ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপটি সবদিক থেকেই বাংলাদেশময় হয়েই থাকলো। টুর্নামেন্টের সব পুরস্কারই পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জেতার পাশাপাশি বাংলাদেশ জিতেছে ফেয়ার প্লে ট্রফিও। এছাড়া টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ৮ গোল করে তিনি জিতে নিয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও। টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হয়েছেন বাংলাদেশের রূপনা চাকমা। ফাইনালে নেপাল যে গোলটি করেছে সেটাই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের জালে প্রথম গোল। ৫ ম্যাচে বাংলাদেশ একটিমাত্র গোলই হজম করেছে। অন্যদিকে পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েরা গোল করেছে ২৩টি।












