দেশে যেমন নকল হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, তেমনি নষ্ট ওষুধ বিক্রি করে মানুষের জীবনকে শঙ্কার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্যানসার, লিভার, হৃদরোগ, কিডনিসহ প্রায় সব রোগের নকল ওষুধে বাজার সয়লাব। বাদ যাচ্ছে না আইসিইউ, সিসিইউয়ের ওষুধ সরঞ্জামও। একে গণহত্যার শামিল হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, মানুষ অসুস্থ হয়ে ওষুধ সেবন করে। আর নকল ওষুধ সেবন করে মানুষ সুস্থ না হয়ে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে। মহামারিতে যে পরিমাণ মানুষ মারা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ খেয়ে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আইসিইউ ও সিসিইউতে চিকিৎসাধীন যে সব রোগীদের নকল ও ভেজাল ওষুধ দেওয়া হয় তাদের মৃত্যু শতভাগ নিশ্চিত বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।
গত ১৭ মার্চ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরীর বৃহত্তম ওষুধের মার্কেট হাজারি গলিতে অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ সময় তিনটি প্রতিষ্ঠানে ৯ লাখ টাকার নষ্ট ইনসুলিন ও টিটেনাস ভ্যাক্সিন পাওয়া গেছে। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও কম তাপমাত্রায় এসব ইনসুলিন ফেলে রাখা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্তের নেতৃত্বে এ অভিযানে নষ্ট ইনসুলিন ও টিটেনাস ভ্যাক্সিনগুলো জব্দ করা হয়। তিন প্রতিষ্ঠানকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, পাশাপাশি সতর্ক করা হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত আজাদীকে বলেন, হাজারী গলির ছবিলা কমপ্লেক্সে অবস্থিত প্যাসিফিক ট্রেডার্স নামের একটি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পড়ে আছে ৩ লাখ টাকার নষ্ট ইনসুলিন। প্রতিটি ইনসুলিনের গায়ে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করার নির্দেশনা থাকলেও কম তাপমাত্রায় ফেলে রাখা হয়েছে। যার ফলে এগুলোর কার্যকারিতা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মূলত বেশি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা সঠিক তাপমাত্রায় ইনসুলিনগুলো সংরক্ষণ না করে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। এসব কারণে দোকান মালিক পল্লব বিশ্বাসকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেন, এরপর একই অভিযোগে নিরুপমা ড্রাগ হাউজ এবং রাজীব ড্রাগ হাউজে অভিযান চালাই। অভিযানে দুটি দোকান থেকে আনুমানিক আরও ৬ লাখ টাকার নষ্ট ইনসুলিন জব্দ করা হয়। এ সকল অভিযোগে দুই দোকান মালিকের প্রত্যেককে ৩০ হাজার করে মোট ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। প্রতীক দত্ত বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট কয়েকটি ফার্মেসির ইনসুলিন কাজ করে না। অধিকাংশ ইনসুলিন লাগেজে করে বিদেশ থেকে আসা। এগুলো অননুমোদিত। বাইরে থেকে আনার সময় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ফলে সেগুলোর কার্যকারিতা তখনই শেষ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারহানা আকতার বলেন, সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করলেও ইনসুলিনের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। যত বেশি তাপমাত্রায় থাকবে, তত বেশি এর কার্যকারিতা কমবে। তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগী এবং যারা পুরোপুরিভাবেই ইনসুলিনের উপর নির্ভরশীল, মেয়াদোত্তীর্ণ ইনসুলিন ব্যবহারে তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া আক্রান্ত কাউকে যদি মেয়াদোত্তীর্ণ ইনসুলিন দেয়া হয়, তবে সুগার অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়ে রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ড্রাগস আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে ১০ বছর। তবে জরিমানার অঙ্ক নির্দিষ্ট না থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু মামলা হওয়ার পর তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফেলে নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা। তাই যে কোনোভাবেই হোক তারা এক শ্রেণির তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফেলে। এ কারণে বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ উৎপাদন।
নকল ওষুধ উৎপাদন, বিক্রি ও বিপণনে যারা জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জোর দাবি জানান তাঁরা। তাঁদের মতে, এক জন খুনি এক জন মানুষকে হত্যা করে। আর নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীরা নীরবে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। তাদের কোনো ক্ষমা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ, নষ্ট ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। তাদের মনিটরিং ব্যবস্থা আরো কার্যকর হতে হবে।