চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৩ এপ্রিল। মরণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণে গত এক বছরে (এ বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত) চট্টগ্রামে ৩৮৫ জনের মৃত্যু হয়। তবে এবার চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। শুধু চলতি এপ্রিলের ২৪ দিনেই করোনা আক্রান্তদের মাঝে শতাধিক (১১২ জনের) মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। যা গত একবছরের মৃত্যুর হারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী- ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা আক্রান্তদের মাঝে সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯৭ জনে। এর মধ্যে নগরে মৃত্যু হয়েছে ৩৭০ জনের। আর উপজেলায় মৃতের সংখ্যা ১২৭ জন। মৃতদের মাঝে পুরুষ ৩৬৫ জন আর মহিলা ১৩২ জন।
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে হঠাৎ মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় দায়িত্বরত চিকিৎসকরা। তাঁরা বলছেন- প্রথম দিকের ভাইরাসের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ের এ ভাইরাসে ভিন্নতা রয়েছে। এবারের ভাইরাসটি বেশ ভয়ংকর। খুব দ্রুত সংক্রমণ ছড়ায়। এছাড়া আক্রান্তের সাথে সাথেই ফুসফুসে সংক্রমিত করছে। আক্রান্ত হওয়ার পরও অধিকাংশের শরীরে কোন ধরণের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। যার কারণে রোগী নিজে বুঝতেই পারছেন না তিনি করোনায় আক্রান্ত। উপসর্গ না থাকায় অন্যদেরও বুঝার কথা নয়।
যখন বুঝতে পারছেন, ততক্ষণে ফুসফুসের ৫০-৬০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তখনই শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। রক্তে অঙিজেনের মাত্রা (অঙিজেন স্যাচুরেশন) কমে যাচ্ছে। রোগীকে তখন ভেন্টিলেটরে (আইসিইউ) দিয়েও বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। মূলত এসব কারণেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর হার বেশি বলে জানিয়েছেন বিআইটিআইডি হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম।
ডা. আব্দুর রব মাসুম বলছেন- দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভাইরাসটি বেশ ভয়ংকর। একজন থেকে অন্যজনে দ্রুত সংক্রমিত করছে। একজন আক্রান্ত হলেই পুরো পরিবার আক্রান্ত হচ্ছে। কেউ বাদ যাচ্ছে না। আবার সংক্রমণের শুরুতেই ফুসফুসে আক্রান্ত করছে। আগে কিন্তু রোগীর ফুসফুস আক্রান্ত হতো কিছুটা দেরিতে। এবার চিত্রটা ভিন্ন। আমরা যেসব রোগী পাচ্ছি, শুরুতেই সবার ফুসফুস ৫০-৬০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ আগে একই পরিস্থিতিতে ২০ শতাংশের মতো ফুসফুসে সংক্রমণ পাওয়া যেতো। তবে আক্রান্ত অনেকের কোন ধরণের উপসর্গ দৃশ্যমান হচ্ছে না, যা এ সময়ে সবচেয়ে ভয়ংকর দিক বলে মনে করেন ডা. আব্দুর রব মাসুম। তিনি বলেন- কোন ধরণের উপসর্গ না থাকায় ওই ব্যক্তি টেস্টও করাচ্ছেন না। যখন বুঝতে পারছেন তিনি আক্রান্ত, ততক্ষণে তার ফুসফুসের ৫০ শতাংশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাছাড়া তার মাধ্যমে ভাইরাসটিও ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে। যেহেতু তার কোন উপসর্গ দৃশ্যমান নয়, সেহেতু তিনি সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশছেন, খাচ্ছেন-ঘুরছেন। সেই সাথে ভয়ংকর ভাইরাসটির চাষও করছেন। এভাবে ভাইরাসটি দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। একই সাথে আক্রান্তের বিষয়টি বুঝতে না পারায় ভাইরাসটি অগোচরেই ফুসফুসসহ রোগীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়ার পরও এসব রোগীকে আর বাঁচানো যাচ্ছে না। তাছাড়া এবার আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি বলে মনে করেন জেনারেল হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম।
ডা. মামুনুর রশীদ বলছেন- ২০২১ সালে যে ভাইরাসটি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তা ভাইরাসটির নতুন একটি ধরণ (ভ্যারিয়েন্ট)। আগের ভাইরাসের তুলনায় নতুন ধরণের এ ভাইরাসের ইনফেকসাস (সংক্রমণের তীব্রতা) তুলনামূলক বেশি। যার কারণে একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যরাও দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে।
এবার আক্রান্তের শুরুতেই ভাইরাসটি রোগীর ফুসফুসে সংক্রমিত (ইনফেকশন) করছে জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, আগে কিন্তু আক্রান্তের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোগীর ফুসফুসে ইনফেকশন পাওয়া যেত। অর্থাৎ রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা যেত একটু দেরিতে। কিন্তু এখন আক্রান্তের ২ থেকে ৩ দিনের মাথায় রোগীর ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ছে এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। প্রথম দিকে রোগী হয়তো বুঝতেই পারছেন না, তিনি আক্রান্ত। যার ফলে অনেকটা অগোচরে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে এবার মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করেন বিআইটিআইডি হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ।









