মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল, জামায়াত নেতা এটিএম আজহার বেকসুর খালাস

আজ সকালে মুক্তি পাবেন, আশা আইনজীবীর

| বুধবার , ২৮ মে, ২০২৫ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ছয় বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার আজহারের আপিল শুনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার বিকালে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিন পৃষ্ঠার ওই সংক্ষিপ্ত এ রায় দেয়।

জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই রায় এল। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে এই প্রথম কেউ খালাস পেলেন। রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাস প্রকাশ করেন আইনজীবীরা। আজহারের আইনজীবী মো. শিশির মনির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। বুধবার সকালেই আজহারুল ইসলাম মুক্তি পাবেন বলে আশা করেছেন শিশির মনির। রায়ের সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। রায়ের পর তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। খবর বিডিনিউজের।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ছয় ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালে আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৯ সালে প্রথমবার আপিল শুনানি করে সেই রায় বহাল রেখেছিল তখনকার আপিল বেঞ্চ। ওই দুই রায় বাতিল করে এখনকার আপিল বিভাগ বলেছে, যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ এই মামলায় ছিল, তা অতীতের আপিল বিভাগ সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম। তখন থেকেই তিনি কারাগারে আছেন। আপিল বিভাগের রায়ে এ টি এম আজহারকে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো মামলা না থাকলে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলেছে সর্বোচ্চ আদালত।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের অন্য ৬ বিচারক হলেনবিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

কোন যুক্তিতে খালাস : এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর যে রায় দিয়েছিল, তা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ১৫ মার্চ। এরপর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ওই বছরের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রিভিউ শুনে ফের আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়। সে অনুযায়ী আপিল শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে দিন ধার্য করে দেয়। মঙ্গলবার বিচারকরা আসন গ্রহণ করার পর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আজহারের আইনজীবী শিশির মনির।

তিনি বলেন, আদালত বলেছেন, অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ এই ভারতীয় সাব কনটিনেন্টের ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি চেইঞ্জ করে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল সবচাইতে বড় ভুল। আরো বলেছেন, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট করা ছাড়াই এটি আজারুল ইসলাম সাহেবকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এবং আরেকটি ইমপর্টেন্ট কথা বলেছেন, যে পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি ট্রাবেস্ট্রি অফ ট্রুথ, অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার। আরো বলেছেন, যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। শিশির মনির বলেন, ফলশ্রুতিতে আজকে এটিএম সাহেবকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য বিজয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগে জামায়তে ইসলামী ও বিএনপির ছয় জন শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রসঙ্গ ধরে শিশির মনির বলেন, পাঁচজন, অন্তত পক্ষে পাঁচজন জেলেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। এটিএম আজারুল ইসলাম সাহেব সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমরা এটা মনে করি, এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি, এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে। এই আইনজীবী বলেন, এখন থেকে জামায়াতে ইসলামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম ইজ অ্যান ইনোসেন্ট ম্যান। শিশির মনির বলেন, তারা আদালতের কাছে একটি ‘শর্ট অর্ডার’ চেয়েছিলেন, আদালত তা মঞ্জুর করেছে। আদালত বলেছেন, আমরা চেষ্টা করব আজকেই যেন এবং আজকে এবং কালকের মধ্যে যেন এই শর্ট অর্ডারটা প্রসেস হয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব মুক্তি পেতে পারেন। এই জন্য সকল আইনি ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব।

আদালতের বাইরে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মহম্মদ তাহির বলেন, আমি কোর্টকে ধন্যবাদ জানাই এবং এই দেশবাসীর প্রতি আমি ধন্যবাদ জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের আন্দোলন সংগ্রামের একটি সুস্পষ্ট সুন্দর রেজাল্ট আজকে বেরিয়ে আসছে।

এদিকে এ টি এম আজহারুল ইসলাম বুধবার সকালেই মুক্তি পাবেন বলে আশা করেছেন তার আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। গতকাল বিকালে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, ‘ইনশাল্লাহ আশা করি আগামীকাল সকালে [১০ টা] জনাব এটিএম আজহারুল ইসলাম ভাই পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পাবেন।’

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার এ কে এম মাসুম জানান, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কার্ডিয়াক ব্লকে চিকিৎসাধীন আছেন আজহারুল ইসলাম। আদালতের আদেশের নথিপত্র পেলে কারা কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।

প্রসিকিউশন যা বলছে : আপিল বিভাগের কার্যক্রম শুরুর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমান প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম আদালতে একটি আবেদনের সংক্ষিপ্তসার জমা দেন। এই আবেদন আগেও একবার জমা দেয়া হয়েছিল। তবে কিছু সংশোধনী এনে তা আবার জমা দেওয়া হয়। আজকের রায় প্রসিকিউশন মেনে নিয়েছেন উল্লেখ করে তামীম বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে আমরা মেনে নিয়েছি এবং মেনে নিতে আমরা বাধ্য।

মানবতাবিরোধী অপরাধের রায় দেয়ার ক্ষেত্রে যে সংশোধিত আবেদন জমা দেয়া হয়েছে সেটি সম্পর্কে তামীম বলেন, ট্রাইব্যুনালের যে রায় এবং যে বিচার সেক্ষেত্রে অ্যাপিলেট ডিভিশন ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই মামলাটা নিষ্পত্তি করবেন এবং আপিল বিভাগের দেয়া যে কোনও আদেশ আমরা মেনে নিব আজকের এই আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বর্তমানে যে মামলাগুলো বিচারধীন আছে অথবা ভবিষ্যতে যে মামলাগুলোর বিচার হবে, সেগুলোতে প্রভাব পড়ে এরকম কোনও আদেশ যেন দেওয়া না হয়, আদালতের কাছে সেই অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানান এই প্রসিকিউটর। তবে এ মামলার সবশেষ ধাপ রিভিউ পর্যায় হওয়াতে এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের আর কোন আইনি পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তামীম বলেন, এই মামলা যেহেতু রিভিউ থেকে আপিলে এসেছে, তাই এর ওপরে বাংলাদেশের আর কোনো আদালত বা আন্তর্জাতিক ফোরাম নেই। তিনি মনে করেন এই রায়ের মাধ্যমে বর্তমান বিচার পদ্ধতি আরও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখালাসের রায়ে আপিল বিভাগের ৪ পর্যবেক্ষণ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড ও টার্মিনালে কন্টেনারের চাপ