৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, ২ লক্ষ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত বিশ্বের বুকে অন্য কোনো জাতিকে দিতে হয়নি। মা–বাবা ও এলাকার দেশপ্রেমিক বাঙালি যুবকদের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারী একজন মৃত্যুঞ্জয়ী বীর শহীদের কথা আজ আমার বার বার মনে পড়ে। জানি না, স্বাধীনতার জন্য শহীদের তালিকায় এই বীরপুরুষের নাম আছে কি না কিংবা তাঁর পরিবার সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে কি না।
আমি বলছিলাম, ফটিকছড়ি উপজেলার ১৪ নং নানুপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শহীদ মৌলভী নুর আহমদ বিএবিএল এর কথা।
মাথায় সব সময় টুপি, শ্মশ্রুমণ্ডিত নুরানী চেহারার লোক নুর আহমদ চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখলে ভক্তি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসত। ভদ্র, বিনয়ী, নিরহংকারী, আল্লাহওয়ালা মানুষ ছিলেন নুর আহমদ চেয়ারম্যান। ওকালতি পেশায় ক্ষেত্র বিশেষে নীতি ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে হয় বলে কিছুদিন কোর্টে গিয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ায় আইন পেশা ছেড়ে দেন। অথচ, এমন এক ফেরেশতা সদৃশ ব্যক্তিকে বেয়নেট খুঁচিয়ে হত্যা করতে জল্লাদ বাহিনীর হাত এতটুকু কাঁপেনি। চেয়ারম্যান সাহেবের অপরাধ ছিল তিনি কেন ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগারদের তালিকা হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছান নি। শুনেছিলাম, তাঁর কাছে যখন তালিকা চাওয়া হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘কার নাম দেব। সবাই তো আমারই লোক।’ ২ জুন, ১৯৭১ পাক বাহিনী যেদিন নানুপুর আক্রমণ করেছিল, সেদিন নুর আহমদ চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বৃদ্ধ মা–বাবাকে হানাদারেরা ধরে বিনাজুরী ব্রীজের নিকট নিয়ে আসে। এই খবর পাওয়া মাত্র চেয়ারম্যান সাহেব তড়িঘড়ি করে নানুপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন এবং বিকেলের দিকে নানুপুর পৌঁছে জল্লাদ বাহিনীর সাথে দেখা করলে তাঁর বৃদ্ধ মা– বাবাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং জল্লাদরা বিনাজুরী ব্রীজের নীচে পৈশাচিক উল্লাসে বেয়নেট খুঁচিয়ে নুর আহমদ চেয়ারম্যানকে হত্যা করে। আশির দশকে নানুপুর মির্জা আবু স্মৃতি কচি–কাঁচার মেলার পক্ষ থেকে আমরা শহীদ নুর আহমদ চেয়ারম্যান এর শাহাদাৎ বার্ষিকী বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করে তাঁকে স্মরণ করতাম। পূর্ব মাইজভাণ্ডার আমতলী গ্রামে চির নিদ্রায় শায়িত শহীদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতাম। সংগঠনটি বিলুপ্ত হওয়ার পর শহীদ নুর আহমদ চেয়ারম্যানও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছেন। আজকের এই দিনে এ মহান আত্মত্যাগী মানুষটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও শহীদ পরিবারের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য সরকারের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শহীদ মৌলভী নুর আহমদ চেয়ারম্যানকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান করুন। আমিন।