মৃত্তিকা একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি আমাদের সৃষ্টি নয়; এটি উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের কাছে এসেছে। মৃত্তিকা বা মাটিকে সুস্থ রাখা আমাদের দায়িত্ব কারণ মাটির শক্তি প্রতিটি জীবনের শক্তি নির্ধারণ করে। এই শক্তি প্রতিটি জীব তার খাদ্যের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। খাদ্য হলো একটি শক্তিশালী ওষুধ। এ প্রসঙ্গে একটি প্রাচীন বৈদিক প্রবাদে বলা হয়েছে, “যখন খাদ্য ঠিক থাকে, তখন ওষুধের প্রয়োজন হয় না; খাদ্য ঠিক না থাকলে ওষুধের কোন লাভ হয় না“।
মানুষ তার খাদ্য উৎপাদনের জন্য আবাদযোগ্য জমির উপর নির্ভরশীল এবং উদ্ভিদ তার পুষ্টি উপাদানের জন্য মাটির উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে (ল্যান্ড), যাদের কোন আবাদযোগ্য জমি নেই । সৌভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশে মোট ভূমির মধ্যে আবাদি জমির (৮৮,২৯,২৬৬ হেক্টর) শতকরা পরিমাণ ৫৫%। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, নগরায়ণ, ইট বাটা ও মৎস্য চাষ ইত্যাদির কারণে প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১% হারে আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে অন্যদিকে ১ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। এই দ্বিমুখি অবস্থা চলতে থাকলে ২০৯২ অর্থাৎ ৭০ বছর পরে বাংলাদেশে কোন আবাদযোগ্য জমি অবশিষ্ট থাকবে না।
মাটি মৃত এবং জীবিত উভয় অবস্থায়ই থাকতে পারে এবং তা নির্ভর করে মৃত্তিকার ৪টি মৌলিক উপাদানের অনুপাতের উপর। সাধারণত: একটি আদর্শ উপরের স্তরের (০–৯ ইঞ্চি) মাটিতে প্রায় ৪৫% খনিজ পদার্থ, ৫% জৈব পদার্থ, এবং পানি ও বাতাস মিলে থাকে প্রায় ৫০%। উদাহরণস্বরূপ মরুভূমির মাটিতে পানি ও জৈব পদার্থের পরিমাণ খুবই কম। তাছাড়া বালি কণার পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি যার কারণে উক্ত মাটিতে পানির পরিমাণ খুবই কম। তাই অনেক ক্ষেত্রে মরুভূমির মাটি উর্বর থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনশীল নয়।
মৃত্তিকা সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০২ সালে ওটঝঝ একটি আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপনের সুপারিশ করেন। এটি ছিল একটি আন্দোলন, যা থাইল্যান্ডে রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে ঋঅঙ সম্মেলন এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ কে প্রথম বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে মনোনীত করেন।
রাজা ভূমিবল মৃত্তিকা সম্পদের গুরুত্ব, তার ভাবনা ও আন্তরিকতা এবং এই সম্পদের প্রতি তার আবেগ সারা বিশ্বে মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের নজর কেড়ে নিয়েছিল। তাই তার সম্মানার্থে এবং তার জন্মদিনের স্মরণে প্রতিবছর ৫ই ডিসেম্বর এই দিবসটি পালন করা হয়।
২০২৩ এ বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: মৃত্তিকা ও পানি: জীবনের উৎস। কারণ মৃত্তিকা এবং পানি উভয়েই হলো জীবনের ভিত্তি, এ দুটি ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে সুস্থ মাটি নিরাপদ পানির উৎসের অবদান রাখে অন্যদিকে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা মাটিকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা পালন করে।
মাটির পানি হলো বিশ্বের বৃহত্তম জলাশয়, বিশ্বব্যাপী সমস্ত স্বাদু পানির দুই তৃতীয়াংশ মাটির জলাশয়ে রয়েছে। মাটির পানি বায়ুমণ্ডল এবং ভূমিপৃষ্ঠের মধ্যে তাপ এবং পানি শক্তির বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের খাদ্যের ৯৫ শতাংশেরও বেশি এই দুটি প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে আসে। উদ্ভিদ দেহে পানির পরিমাণ প্রায় ৯৫%। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সেচযুক্ত জমি থেকে ১ কেজি ধান উৎপাদনের জন্য ২৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ পানি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। মাটি এবং পানি হলো সেই মাধ্যম যেখানে গাছপালা বেড়ে ওঠে, প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে যা আমাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করে। স্বাস্থ্যকর মাটি একটি প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এটি পানিকে বিশুদ্ধ ও সংরক্ষণ করে।
আমাদেরকে বন্যা ও খরা থেকে রক্ষা করে, অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করে এবং বিলিয়ন জীবের বাসস্থান হিসাবে কাজ করে। স্বাস্থ্যকর মাটি কার্বন সিঙ্ক হিসাবে কাজ করে জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করে।
অন্যদিকে অনাবৃষ্টি, দীর্ঘমেয়াদী অতিরিক্ত রোদে বা ইটের জন্য পোড়ালে, অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও পেস্টিসাইড ব্যবহারে, শিল্প, কৃষি ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, খনি এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কার্যক্রম, অ্যাসিড বৃষ্টি, নিবিড় চাষ, রাস্তার ধ্বংসাবশেষ, মাটিতে শিল্প বর্জ্য সরাসরি নিষ্কাশন, কয়লা ছাই, ভারী ধাতু যেমন ক্যাডমিয়াম, লেড সিসা, মার্কারি, আর্সেনিক, ক্রোমিয়ামের আধিক্যে মাটি মৃত বা দূষিত হয়, তাছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য দীর্ঘদিন পরিবেশে অবস্থানের কারণে উদ্ভিদের পুষ্টি ও পানি গ্রহণ এবং চলাচলে বাধা প্রদানের মাধ্যমে মৃত্তিকাকে অনুর্বর করে ফেলে। দূষণের ফলে মাটি যেমন তার উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তেমনি দূষকগুলো খাবার, শ্বসন ও ত্বক ভেদ করে মানবদেহে ঢুকে নানা প্রকার জটিল রোগ তৈরি করে।
বিভিন্ন কারণে মাটি মৃত অবস্থায় থাকে বলেই আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে (২:১৬৪; ৭:৫৭ ৩৬:৩৩) উল্লেখ করেছেন যে, “আমি মেঘমালা থেকে পানি বর্ষণ করে মৃত ভূমিকে জীবিত করি এবং তা থেকে ফসল বাহির করে আনি“।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মৃত্তিকাকে সুস্থ রাখার সুপারিশ সমূহ:
১। জমিতে বিভিন্ন ধরনের জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়ে অতিমাত্রায় রাসায়নিক স্যারের ব্যবহার কমিয়ে আনা। তাতে মাটি সুস্থ থাকবে এবং পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়বে। ২। পরিমিত পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা। রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে মৃত্তিকার সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এর সার সুপারিশ মালা এবং কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেওয়া। ৩। গ্রামাঞ্চলে এলো পাথারি ঘরবাড়ি নির্মাণ না করে পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা। ৪। কৃষি জমির অপচয় রোধে হাউসিং কোম্পানির গুলোর উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখা।
৫। কৃষক তার জমির উপরে মাটির বিক্রি বা সরানোর ক্ষেত্রে এসআরডিআই এর কর্মকর্তার/দের অনুমোদন নেওয়ার ব্যবস্থা করা। ৬। আবাদি জমি রক্ষার্থে নতুন করে কোন ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি প্রদান না করা এবং মাটি পোড়ানো ক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধ সকল ইটভাটাকে নিরুৎসাহিত করে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট কারখানা স্থাপনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এ ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর ব্লকেট ব্যবহারের আইনটি বাস্তবায়িত করা। ৭। পাহাড় কাটা রোধ ও উপরের স্তরের (০ – ৯ ইঞ্চি) মাটি সংরক্ষণের জন্যে এই স্তরের মাটি বিক্রয় বা সরানোর ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করা। শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে মাটি বলতে উপরের স্তরের মাটিকেই বুঝায়। সমতল ভূমিতে ১ ইঞ্চি মাটি তৈরি হতে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় লাগে। ৮। পলিব্যাগ ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্রাস্টিকের সরবরাহ, ব্যবহার ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা।
৯। আইনের যথাযথ প্রয়োগ (সরকার কর্তৃক ২০১০ সালের কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, পাহাড় কাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০২৬ সালের মধ্যে একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ৮০% এ কমিয়ে আনার নির্দেশনা) নিশ্চিত করা। ১০। ভারী ধাতু দ্বারা আবাদি জমির মাটি দূষণের ক্ষেত্রে প্লাবিত অবস্থায় শস্য উৎপাদন করা। ১১। পাঠ্যসূচিতে মৃত্তিকা সম্পদ সম্পর্কে পাঠদান ও জনসাধারণকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমে সচেতন করা। ১২। বনভূমি ধ্বংস না করে বেশি করে গাছ রোপনে উৎসাহ প্রদান করা। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে এবং ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রীষ্মের দুপুরে একটি বড় গাছ কমপক্ষে ১০০ গেলন পানি বাতাসে নির্গত করে পরিবেশ ঠান্ডা রাখে। বৃক্ষ শব্দ দূষণে নিয়ন্ত্রণে ও মাটিতে জৈব পদার্থ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পরিবেশের বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য একটি ফলদ, একটি বনজ ও একটি ভেষজ গাছ রোপনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
জীবন ও পরিবেশ রক্ষার্থে মৃত্তিকা ও পানির ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই প্রাকৃতিক সম্পদ মৃত্তিকাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ অবস্থায় রেখে যাওয়া আমাদের সকল মহলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক : প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।