বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় খুব বেশি না বলে দাবি করেছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঋণ নেওয়া হলেও ঋণনির্ভর উন্নয়ন শব্দটিতেও তার আপত্তি আছে। গত ১ মার্চ মন্ত্রিসভায় নতুন করে যে ৭ জন প্রতিমন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের একজন ওয়াসিকা। গত তিন মেয়াদে তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম নারী অর্থ প্রতিমন্ত্রী। আগামী ৬ জুন আগামী অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেটি প্রণয়নে যুক্ত ওয়াসিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে। তবে প্রধান্য পেয়েছে বাজেট।
তিনি বলেছেন, বাজেটে নির্বাচনী ইশতেহারের অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাজেট ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পরিকল্পনাই তারা নিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণত দুই উপায়ে রোধ করা হয়, একটি ভোক্তার চাহিদা কমিয়ে এবং অন্যটি বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে। মুদ্রানীতির প্রচলিত পদ্ধতি মূলত ভোক্তার চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে। প্রণোদনা ও ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে উৎসাহ দেয় রাজস্ব নীতি। এর আওতায় কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে চাহিদা কমিয়েও মূল্যস্ফীতি কমানো প্রচেষ্টা জোরদার করা যায়। মুদ্রানীতির আওতায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির এলসি মার্জিন শিথিল করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে সংকোচনশীল মুদ্রা নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় মে ২০২৪ নাগাদ বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদ হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৪ সালের ৮ মে থেকে বাজারভিত্তিক সুদ হার নির্ধারণ করা হয়েছে। নীতি সুদ হার বাড়ানো হয়েছে। রাজস্বনীতির আওতায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন, বাজার মনিটরিং, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জরুরি আমদানি।
সরকার ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে সর্বোচ্চ সংযমের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জমি অধিগ্রহণ, গাড়ি ক্রয়, ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারি অর্থ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সার্বিক বাজেট ঘাটতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রকৃত ঘাটতির পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কৃষি উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারে নিয়মিত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে দাম বাড়তি থাকায় গত এক বছরে এই খাতে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। অতি মুনাফার লোভ বন্ধ করতে সরকার বাজার মনিটরিং জোরদার করেছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তদারকিতে বিশেষ দল কাজ করছে। পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিলে আমদানির মাধ্যমে তা উত্তরণের প্রচেষ্টা একটি প্রচলিত পদ্ধতি। সরকার এ পদ্ধতি অবলম্বন করছে।
অন্য যেসব বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ের মূল্যের তুলনা করে সরবরাহ চেইনের ত্রুটি নির্ণয় করা। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, প্যাকেজিং এবং স্টোরেজ বাড়ানোর জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতে উদ্যোগ গ্রহণ করা, খুচরা এবং পাইকারি বাজার মনিটরিং জোরদার করা, আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে বাজার মূল্যের সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টাও চলছে। স্বল্প আয়ের জনগণের জন্য সুরক্ষার পরিসর বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বিনা বা স্বল্প মূল্যে খাদ্য বিতরণ, ফ্যামিলি কার্ডের মতো কার্যক্রমসমূহ চলমান রয়েছে।
সরকারে নতুন মেয়াদের প্রথম বাজেটে জোর কোথায়? কোন দর্শনকে সামনে রেখে আগাচ্ছে সরকার? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারের অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাজেট ঘাটতি সহনীয় পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী রাখা, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাশ্রয়ী, টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক, জ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে।
তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক রিজার্ভ পুনর্গঠনও আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, কৃষি, শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এগুলো বরাবরের মতো আমাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে থাকবে। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। সরকার অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাই ঋণের পরিমাণ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আইএমএফ কর্তৃক যে থ্রেশল্ড লিমিট দেওয়া আছে, অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ৪০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না, আমাদের ঋণ জিডিপির অনুপাত তার চেয়ে অনেক কম (১৫.৭ শতাংশ)। তাই এই বিষয়ে আশঙ্কার কিছু নেই।
আমরা ঋণনির্ভর উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি কিনা? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, না, আমরা ঋণনির্ভর উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি না। এছাড়া জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ের যে ব্যবস্থা চালু হয়েছে তার ফলে জ্বালানি তেলের উপর ভর্তুকি কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি। সরকার প্রত্যেক বছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট বরাদ্দ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছেও বলে জানান তিনি।
রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধির ধীর গতি, ভর্তুকি কমানোর চাপ, বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ–এসব বিবেচনায় আমরা কোন পথে রয়েছি? জবাবে ওয়াসিকা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তার ফলে ভোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদির উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এবং এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। তবে যেহেতু মূল্যস্ফীতিই এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং সাধারণ মানুষকে এর চাপ থেকে দ্রুত পরিত্রাণ দেয়া প্রয়োজন, সেহেতু আমরা এই মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অনেক বেশি হলো কিনা তা নিয়ে খুব একটা ভাবছি না। তবে আমাদের সংকোচনমূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.৮ শতাংশ হবে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে কিন্তু এ হারকে বেশ উচ্চ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কিন্তু হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত নীতিকৌশল জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে খুব বেশি প্রভাবিত করবে না।