মুরাদপুর শুলকবহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন ভাবনা

সিডিএ অ্যাভিনিউর নিচে থাকা ক্রস কালভার্ট ভেঙে হবে আরসিসি ব্রিজ ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু, সময় লাগতে পারে ৬ থেকে ৯ মাস কাজ চলাকালীন যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখার পরিকল্পনা

মোরশেদ তালুকদার | বৃহস্পতিবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বর্ষায় ভারী বৃষ্টিতে ডুবে চট্টগ্রাম শহর। আবার শহরের অন্যান্য জায়গা থেকে পানি নেমে গেলেও সিডিএ অ্যাভিনিউর বহাদ্দারহাটমুরাদপুর অংশের মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর এবং ফ্লাইওভারে ওঠানামার মুখে মুরাদপুর কনভেনশন হলের সামনে থেকে পানি নামে না। এতে ডুবে থাকা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মূল সড়কসহ ফ্লাইওভারেও দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে রাস্তার এক পাশের মির্জা খাল এবং অন্য পাশের চশমা খাল প্রশস্ত করা হয় জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের আওতায়। উঁচু করা হয় সিডিএ অ্যাভিনিউর ওই অংশটি। এতেও সুফল মিলেনি।

অবশেষে মুরাদপুরমোহাম্মদপুরশুলকবহরসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে নতুন পথে হাঁটছে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনী। এর অংশ হিসেবে মুরাদপুর কনভেনশন হলের সামনে সিডিএ অ্যাভিনিউর নিচে থাকা ক্রস কালভার্টটি ভেঙে নতুন করে আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান কালভার্টটি চশমা খালের সঙ্গে মির্জা খালকে সংযুক্ত করেছে। মূল সড়ক থেকে নিচু হওয়া, ময়লাআর্বজনায় ভরাট হওয়া এবং বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিসের কারণে এ কালভার্টটি দিয়ে পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে কালভার্টের পানি প্রবাহিত হয় সিডিএ অ্যাভিনিউ’র ওপর। এতে জলাবদ্ধতায় হয় সেখানে। নতুন করে ব্রিজ নির্মাণ হলে এ সমস্যার সমাধান হবে। আগামী মাসের (ফেব্রুয়ারি) প্রথম সপ্তাহ থেকে ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু করার কথা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ব্রিজ নির্মাণের সমাসীমা ধরা হয় ৯ মাস। তবে ব্রিজ নির্মাণ শুরু হলে নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে। সিডিএ অ্যাভিনিউ প্রধান সড়ক হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার যান চলাচল করে এ রাস্তা দিয়ে। এ সড়ক হয়েই ওঠতে হবে ফ্লাইওভারে। ফলে ব্রিজ নির্মাণ শুরু হলে ভেঙে পড়তে পারে ট্রাফিক ব্যবস্থা। তখন যানজট নিয়ন্ত্রণের নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে। তবে এসব বিবেচনায় নিয়ে জনদুর্ভোগ এড়াতে তিনভাগে কালভার্টটি নির্মাণ করা হবে। যাতে একটি অংশে কাজ চললে অপর দুই অংশ দিয়ে যান চলাচল করতে পারে। এরপরও সময়িক ভোগান্তি হলেও বৃহত্তর স্বার্থে তা মেনে নেয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া কালভার্টের দুই পাশে ১২শ এবং ৯শ মিলি লিটারে ডায়া বিশিষ্ট দুটো ওয়াসার মেইন পাইপলাইন রয়েছে। আছে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লইন। অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস লাইন সরানো গেলেও এগুলো সরানো যাচ্ছে না। ফলে কাজ শেষ করাও কিছুটা চ্যালেঞ্জ হবে।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে ক্রস কালভার্টটি নির্মাণ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। বর্তমানে এটির দৈর্ঘ্য ৩২ মিটার এবং প্রস্ত ৭ মিটার। উচ্চতায় ২ দশমিক ৭ মিটার। নতুন করে নির্মাণের পর এর দৈর্ঘ্য হবে ৪০ মিটার। প্রস্ত হবে ১২ মিটার। তলা থেকে উচ্চতা হবে ৫ মিটার। এদিকে গতকাল দুপুরে ব্রিজ নির্মাণের স্থানটি পরিদর্শন করেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শামসুল আলম, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ আহমেদ, ডিসি ট্রাফিক (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি জয়নুল আবেদীনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, সিডিএ অ্যাভিনিউর সমান্তরালে ষোলশহর দুই নম্বর গেট মোড় থেকে মুরাদপুর কনভেনশন হল পর্যন্ত (মুরাদপুর ফ্লাইওভার যেখানে নেমেছে) আরসিসি ঢালাই দিয়ে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় প্রায় ২৭ ফুট চওড়া ও ১৫ ফুট চশমা খাল প্রশস্ত করা হয়। চশমা খাল দিয়ে দিয়ে নেমে পানি চলে যায় কালারপুলের দিকে। মুরাদপুর কনভেনশন হলের সামনে সিডিএ অ্যাভিনিউর বিপরীত প্রান্তে মির্জা খালের পানি ওই ক্রস কালভার্টের মাধ্যমে এসে চশমা খালে পড়ে। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, সুগন্ধা আাবাসিক এলাকা, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি প্রভৃতি দিক থেকে আসা পানি মির্জা খাল দিয়ে নেমে এসে সিডিএ অ্যাভিনিউ রোডের কাছে এসে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটি শাখা সিডিএ অ্যাভিনিউ পার হয়ে ক্রস কালভার্টের মাধ্যমে মুরাদপুর থেকে আসা ওই চশমা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অপর শাখাটি সিডিএ অ্যাভিনিউ রোডের সমান্তরালে বহদ্দারহাট পুলিশ বঙের পাশ দিয়ে চাক্তাই ডাইভারশন খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

কী বলছেন প্রকল্প পরিচালক : প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ আজাদীকে বলেন, আমাদের ড্রেনেজ মডেলেও ব্রিজটি আছে। তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ এবং চালু সড়ক হওয়ায় রিস্কটা এতদিন নিইনি। এ বছর রিস্কটা নিচ্ছি। এতে মুরাদপুরটা হয়তো জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাবে।

কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে জানতে চাইলে বলেন, আশা করছি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে থেকে কাজ শুরু করতে পারব। ব্রিজটা নির্মাণ করা একটু কঠিন। ফ্লাইওভার থেকে নেমেই দ্রুতগামী গাড়িগুলো একটু বাধার মুুখে পড়বে। এতে পিক আওয়ারে ট্রাফিক জ্যাম হবে। দেখা যাবে ফ্লাইওভারে জ্যাম হয়ে যাবে। পুরো শহরে প্রভাব পড়ার সম্ভবনা আছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তিন ভাগে করব। যাতে দুটো লাইন সবসময় খোলা থাকে।

তিনি বলেন, প্রতি বর্ষায় মুরাদপুরের ওই কোণাটায় সবচেয়ে বেশি পানি থাকে। এটা কমিয়ে নিয়ে আনার জন্য আমরা নানাভাবে এনালাইসিস করেছি। তখন চশমা খালের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করে পানি প্রবাহের গতি বৃদ্ধির বিষয়টি বলা হয়। গতবছর তাই করেছি। তারপরও ওখানে পানি জমেছে। সিটি কর্পোরেশন রাস্তা উঁচু করেছে। আমরা চশমা খাল প্রশস্ত করেছি। এরপরও জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুরাদপুর মুক্ত হয়নি। এটা কন্ট্রোলে আনার জন্য ব্রিজটা করতেই হবে। জনগণের সাময়িক হয়তো ভোগান্তি হবে। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে এ দুর্ভোগ সাময়িক মেনে নিতে হবে।

এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, মির্জা খালের পানির ফ্লো বাড়ানো গেলে এবং বহাদ্দারহাট পর্যন্ত যদি পানি প্রবাহের পথ করা যায় তাহলে চশমা খালের ওভার ফ্লো হবে না। এতে মুরাদপুরের ওই অংশটাও আর ডুববে না। মির্জা খালের কাজটা শেষ করেছি। কিন্তু ওখানে সার্বক্ষণিক যে ফ্লো সেটা এই কালভার্টের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। এই কালভার্টের নিচে এতো ইউটিলিটি লাইন পানি যেতে পারে না। তাই এটা উঁচু করা এবং এখানে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সে জন্য এখানে নতুন করে ব্রিজ করার চিন্তা করেছি।

সম্ভাব্য যানজট নিয়ে সতর্ক ট্রাফিক বিভাগ : সিএমপির ডিসি ট্রাফিক (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি জয়নুল আবেদীন আজাদীকে বলেন, ব্রিজটি শেষ করতে ৬ থেকে ৯ মাস লাগতে পারে। রোডটির বিকল্প কোনো সড়ক নেই। আবার ফ্লাইওভারে ওঠানামা এবং এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে’তেও ওঠার পথ এটি। যার কারণে এখানে প্রচুর পরিমাণে গাড়ির চাপ থাকবে। ফ্লাইওভার ওঠানামা এবং মূল সড়ক দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলোর চাপ একটা সিগন্যাল রোডে নেয়া খুব ডিফিকাল্ট হবে, ফলে এখানে প্রচুর যানজট হবে। এ যানজট কমিয়ে আনার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এরপরও বড়ধরনের যানজট মোকাবেলার জন্য চট্টগ্রামবাসীকে অপেক্ষা করতে হবে, এটার বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, মুরাদপুর থেকে এসে কিছু গাড়ি ফ্লাইওভারে ওঠে। কাজ শুরু হলে তাদের বহাদ্দারহাট থেকে ঘুরে আসতে হবে। আবার মুরাদপুর থেকে কিছু গাড়ি আসবে আবার কিছু গাড়ি ফ্লাইওভার থেকে নামবে, দুটোই মুখোমুখি হয়ে নামবে। যেহেতু কাজের জন্য নামার পথে রাস্তা সংকীর্ণ হবে তাই গাড়িও স্লো হবে। আবার সামনে আসছে বর্ষা। তাই বৃষ্টি হলে যাতায়াতে কিছুটা ভোগান্তি হবে। ফলে একটি গাড়ি যাতায়াতে যে সময়টা লাগবে এর প্রভাবে যানজট হতে পারে।

তিনি বলেন, যেহেতু আশেপাশে জায়গা নেই। রাস্তাও প্রশস্ত করা যাবে না। এর মধ্যেও যানজট নিরসনে আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না। মিড আইল্যান্ড তোলে রাস্তাকে যতটুকু সম্ভব প্রশস্ত করে অন্তত গাড়ির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করব।

তিনি বলেন, বাওয়া স্কুলের সামনে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প এর কাজ চলছে। বাওয়া স্কুল কেন্দ্রিক সেখানে এমনিতেই একটা জ্যাম থাকে। এখন মুরাদপুরেরটা যোগ হবে। সামনে আসছে রমজান মাস। তখন গাড়ির বাড়তি চাপ থাকে। ফলে কিছুটা ভোগান্তি তো হবেই। কিন্তু উন্নয়নের স্বার্থে কাজ তো অবশ্যই করতে হবে। তাই সাময়িক কষ্ট হলেও তা মেনে নিতে হবে। কারণ জলাবদ্ধতাও তো বড় সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্যই তো ব্রিজটা করা হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাতের ভোটে জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
পরবর্তী নিবন্ধপাচারের অর্থ ফেরাতে বিদেশি বন্ধুদের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা