জান নিসার আখতার, জাভেদ আখতার, ফারহান আখতার অথবা জোয়া আখতার–হাল জমানার নামগুলো জানবার জন্য জ্ঞান গম্মি অলা সাহিত্যপ্রেমী না হলেও চলে। ভারতীয় শিল্প সংস্কৃতির বেশ পরিচিত মুখ এঁরা। কিন্তু যদি বলি কবি মুযতার খায়রাবাদি। তাহলে বেশিরভাগ কবিতা প্রেমী বাঙালিই ভ্রু কুঁচকোবেন সন্দেহ নেই। সম্পর্কে জাভেদ আখতার সাহেবের পিতামহ এই মুযতার মহোদয়। উর্দু–হিন্দি সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে বিশেষ প্রিয় হলেও বাংলাদেশে তেমন পরিচিত নন এই সুফিকবি। ১৮৬৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের খায়রাবাদে জন্ম নেয়া মুযতার খায়রাবাদি নামে খ্যাত মানুষটার নাম আসলে ইফতেখার হুসেইন। আন্দামানে নির্বাসিত বৃটিশযোদ্ধা, অখন্ড ভারতের ফিকাহ শাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যবোদ্ধা ফজলে হক খায়রাবাদি ছিলেন মুযতারের পিতামহ। মুঘল সময়কাল থেকেই বংশপরম্পরায় জ্ঞান, সাহিত্য ও ধর্মে উৎসর্গিত এই সুফিবাদী পরিবারটি। উত্তরপুরুষের নাম পরিচিতির সুবিধার্তে শুরুতেই বলেছি। পাঠকপ্রিয়তা পাওয়া ভারতের এক সময়ের সাহিত্য পত্রিকা ‘শারিশমা এ দিলবার’–এর সম্পাদক মুযতারকে নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, পুস্তিকা তেমন না হলেও বিদগ্ধ বোদ্ধা মহল থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় তিনি অনায়াসে পৌঁছে গিয়েছিলেন জন্মলব্ধ প্রতিভা বলে। তাঁর লেখা ‘নাজরে খোদা’ (কাব্য সংকলন) ‘মার্গে গালাত কি ফরিয়াদ’ (কবিতা), ‘মিলাদে মুস্তফা’ (নাতে রাসুল স:), ‘বেহরে তাবিল’ (কবিতা) সহ গ্রন্থগুলো পাঠক লুফে নিয়েছিলো বলা যায়।
বেশ কয়েক বছর আগে শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে পূর্ণ যৌবনা মৈত্রেয়ীর ছবির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি পাশে এক অশীতিপর তরুণ গুনগুন করে গাইছেন “মুজরিম হুঁ মোহাব্বত কা আয়া হুঁ ম্যায় ফারিয়াদি…”! চমকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলাম–কোথায় পেলেন এই লিরিক? বললেন এটা একটা সুফি কবিতা বাবা, কবির নাম মুযতার! তুমি বুঝবে না। পরে আলাপে জানা গেল তিরাশি বছরের এই মুযতার–প্রেমী তরুণের বাড়ি সিলেট। বিদায় নিতে নিতে বলেছিলাম আপনার মুযতার আমারও খুব প্রিয়, একদিন তাঁকে নিয়ে লিখবো এবং আপনাকে পাঠাবো! ১৪ বছর লেগে গেলো সেই কথা রাখতে। সিলেটের আম্বরখানার সেই তরুণ কি অপেক্ষায় আছেন আদৌ? জানি না আছেন কিনা তবে এ–ই তো এক বিস্ময় যে ভারতের উত্তর প্রদেশের এক কবি প্রাণ কেড়েছেন সিলেটের খালিদের।
ফলভারে নত বৃক্ষ কথাটি খাটে মুযতারের বেলায়। বিনীতের অযোগ্যতাও পারিপার্শ্বিক উপস্থিতির ভালোবাসা, আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা লুটে নেয় আর দুর্বিনীতের যোগ্যতা সাফল্যের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকৃতি পেলেও তার কপালে ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা জোটে না। উল্টো তা মর্ম হারিয়ে মর্মন্তুদ পরিণতি লাভ করে কখনো কখনো। পরিণত মানুষের সংবেদী চোখে তা হাস্যকর হয়ে ধরা দেয়। সমাজ স্বীকার করলেও অশ্রদ্ধাপূর্ণ কটাক্ষে কটিবসন গুটিয়ে গালাগাল দিতেও দ্বিধাবোধ করে না। মুযতার তাই যেন নিঃশঙ্কচিত্তে নিজের অহংবোধকে তীব্র আঘাত করে গেছেন আজম্ম। খায়রাবাদের ঈশ্বরপ্রেমী অসামপ্রদায়িক দর্শনের হৃৎ–কড়িয়াল কোকিল স্বীয় তানে আমৃত্যু মধ্যমার সীমারেখা ভেঙে বেজে গেছেন কড়িমধ্যমে। তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়েই কাজটি তিনি করেছেন খুব সচেতনভাবে। দর্পের দন্তে দেগেছেন দুর্মর ডাং। ভূষিত হয়েছিলেন খান বাহাদুর, এতবারুল মুলক, ইফতেখারুশ শুরা সহ নানা উপাধিতে। ঈর্ষনীয় খ্যাতি নিয়েও বিনয়াবনত পদক্ষেপে পার করেছেন আয়ুষ্কাল। কবি হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার জন্য যেখানে এ যুগে অর্থ বা প্রণয়–মূল্যে অন্যের পাণ্ডুলিপি খরিদ করে নিজের নামে ছাপানোর অভিযোগ পাওয়া যায় সেখানে আত্মভোলা এই কবির অসংখ্য সাহিত্যকর্ম হারিয়ে গেছে যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে।
শব্দের গঠনে অদ্ভুত সম্মোহন আর বাক্যে এক অনুচ্চ আওয়াজের আর্তনাদ যা বেদনাকে বাঙ্ময় করে তোলে নীমিলিত চোখের রক্তাশ্রু ফোটায় মুযতার সেই ঐশী প্রেমের কবি। তাঁর প্রেম বা বেদনার প্রকাশ স্বল্প ও সহজ শব্দে ব্যাপকার্থের দিকে নিয়ে যায়। বিচ্ছেদ বা ব্যবচ্ছেদ দুটোই একই সমেত পূর্ণতা লাভ করে যার মোহনায় মুযতার সেই নদী। এর মিঠেপানিতে তৃষ্ণা মেটানোর হলে রচিত ভাষাতেই শুনতে বা পড়তে হবে। উর্দু বা চলিত হিন্দি পৌরুষদীপ্ত ভাষা হলেও এতে প্রেম তার পূর্ণ যৌবন নিয়েই পরিস্ফুটিত হয়। প্রায়শই তরজুমা তামাসায় পরিণত হয় যেহেতু ভাষান্তরে কাব্যের সেই মৌলিক স্বাদ বা আবেদন জৌলুশ হারিয়ে ফেলে তাই পাঠক হয়তো মূল্যায়নে খানিকটা কৃপণ হয়ে পড়েন। মুযতারের বর্ণিল রঙে হৃদয় রাঙাতে চাইলে পড়তে হবে রচিত ভাষাতেই। ১৯২৭ সালের মার্চে বিদায় নিয়ে গোয়ালিয়ড়ে সমাধিস্থ হওয়া এই কবির কিছু কবিতা আগ্রহী পাঠকের জন্য অযোগ্য হাতে অনুবাদের চেষ্টা করলাম।
১.
যৌবনের নখরে আমি আটকে রইলাম কত শত কাল
কোথায় গিয়েছিলে তুমি আমার শৈশব নষ্ট করে?
২.
আমি সেই খারাপ তবে নই খারাপ মানুষের দলে,
তুমি সেই ভালো যে কারো ভালো করেনি কোনোকালে।
৩.
এই এক আমি যে কিনা তোমাকে প্রেমাস্পদ বানিয়ে ছেড়েছে, আরেক হলে তুমি যে কিনা আমার ধ্বংসের বাকি রাখেনি কিছুই।
৪.
তার দুটো বেণীতে আটকা পড়েছে হৃদয় আমার
এ বলে আমার আর সে বলে তার!
৫.
তার কোমলতম করকমল যেন ক্ষুরধার শীতল ছুরি। ঘাড় আমার আনন্দেই কেটে গেল!
৬.
তার ঘুম পাচ্ছিলো এতো ভীষণ
আমার গল্পটা শেষ করতেই হলো।
৭.
দুটো সময়ই আমি কেবল পুড়তে পুড়তে গেছি/এক–তুমি আসার আগে, দুই–তুমি যাবার পর!