দীর্ঘদিন ধরে পেট্রোল পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেলে ভেজাল, ওজনে কম দেয়াসহ নানা অনিয়ম রোধে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ নতুন পেট্রোল পাম্প অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করে দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
কার্যত ২০১৭ সাল থেকে নতুন পেট্রোল পাম্প কিংবা ফিলিং স্টেশন অনুমোদন বন্ধ থাকলেও ২০১৯ সালের ২৪ জুন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অপারেশন-১ অধিশাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার স্বাক্ষরিত পত্রে বিপিসি ও এর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি জ্বালানি তেল বিপণন ব্যবস্থায় ভেজাল রোধে ও সঠিক পরিমাপে জ্বালানি সরবরাহে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা না পর্যন্ত নতুন ফিলিং স্টেশন/ সার্ভিস স্টেশন স্থাপন অনুমোদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এরপর থেকে নতুন ফিলিং স্টেশন অনুমোদন বন্ধ থাকলেও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাথে বিপিসির নানা দেন-দরবার চলে নিয়মিত। বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান সামছুর রহমান কোন কোন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন ফিলিং স্টেশন অনুমোদন দেয়া যেতে পারে এমন মতামত চেয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে চিঠি দিলে ক্ষুব্ধ হন তৎকালীন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব। এরপর থেকে আটকে যায় নতুন ফিলিং স্টেশন অনুমোদন। এখনও সেই চিঠির জবাব পায়নি বিপিসি।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে সারা দেশে ৯টি মডেল ফিলিং স্টেশন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিপিসি। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে আধুনিক বিশ্বমানের এসব ফিলিং স্টেশন স্থাপনের নকশা অনুমোদন দেয়া হয়। উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার স্বাক্ষরিত ওই পত্রে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী মডেল ফিলিং স্টেশন স্থাপনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিপিসি চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
মডেল ফিলিং স্টেশনে থাকবে আধুনিক ফার্মেসি, এটিএম বুথ, আন্তর্জাতিক মানের রেস্টুরেন্ট, শৌচাগার, কিডস জোন, ভিআইপি লাউঞ্জ, সুভ্যেনির শপ, সুপার শপসহ নামাজ পড়ার জন্য এবাদতখানার সুবিধা। যাত্রীরা লম্বা ভ্রমণ করতে গিয়ে যাতে ক্লান্তি লাগলে যাতে পথিমধ্যে এসব ফিলিং স্টেশনে বিশ্রাম নিতে পারেন সে ব্যবস্থাও থাকবে এসব ফিলিং স্টেশনে। সাধারণত ইউরোপ ও আমেরিকার স্টেশনগুলোতে এ ব্যবস্থা থাকে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে মডেল ফিলিং স্টেশনগুলো বসানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক পর্যায়ে বিপিসি থেকে প্রতিটি মডেল ফিলিং স্টেশন করার জন্য ২.২৫ একর জমির কথা উল্লেখ করে নকশাসহ প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। তবে অনেকে অনুমোদিত নকশাকে পাত্তা না দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে। এতে বিপত্তি তৈরি হলে মন্ত্রণালয় থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, বিপিসির প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিপণন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ কমিটিতে রাখা হয়। কমিটি কয়েকটি নির্মাণাধীন ফিলিং স্টেশন পরিদর্শন করে নকশার গড়মিল পেয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে প্রতিবেদন দেয়। এতে বিপত্তি তৈরি হলে প্রভাবশালীদের চাপে একেক ফিলিং স্টেশনের জন্য পৃথক পৃথক নকশা অনুমোদন দেয়ার প্রস্তাব জানিয়ে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বিপিসি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে ৭টি মডেল ফিলিং স্টেশনের অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তন্মধ্যে পদ্মা ও যমুনা অয়েল দুটি করে, মেঘনা পেট্রোলিয়াম তিনটি মডেল ফিলিং স্টেশন নির্মাণের অনুমতি পায়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে দুটি মডেল ফিলিং স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। তন্মধ্যে সীতাকুণ্ডে নির্মিতব্য মেসার্স ডিএবি ফিলিং স্টেশনটিতে কোন নিয়মই মানা হয়নি। মেসার্স ডিএবি ফিলিং স্টেশনটি অনুমোদন দেয়া পর নির্মাণ শুরু হলে বিপিসি জানতে পারে এখানে নকশা অনুযায়ী ফিলিং স্টেশনটি নির্মিত হচ্ছে না। পরবর্তীতে নকশা সংশোধনের জন্য চলতি বছরের ১৪ মার্চ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবরে চিঠি দেয় বিপিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. আবু বকর ছিদ্দীক। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ডিএবি ফিলিং স্টেশনের ভূমির আকৃতিগত কারণে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ অনুমোদিত নকশায় কিছু পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, অনুমোদিত নকশাতে ফিলিং স্টেশনের অবকাঠামো অর্থাৎ ডিসপেন্সিং ইউনিট, ট্যাংকসমূহ, সম্মুখ অংশের বাগান ইত্যাদি প্রাঙ্গনের সম্মুখ অংশে দেখানো হয়েছে। এবং অন্যান্য সুবিধাদি যেমন-রেস্টুরেন্ট, সেলস কাউন্টার, টয়লেট, লুব গুদাম, কার ওয়াশ, জেনারেটর রুম, ওয়াস জোন, ওয়াটার জোন ইত্যাদি প্রাঙ্গনের পিছনে দেখানো হয়েছে। ডিএবি ফিলিং স্টেশনের প্রস্তাবিত স্থানে পেছনের অংশে বসতবাড়ি ও নালা বিদ্যমান থাকায় পেছনে অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ নেই। এতে ডিসপেন্সিং ইউনিট, ট্যাংকসমূহ ও সম্মুখ অংশের বাগান প্রাঙ্গনের উত্তরে এবং অন্যান্য সার্ভিস সুবিধাদি প্রাঙ্গনের দক্ষিণে আকার আয়তন অক্ষুণ্ন রেখে স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়। বিপিসির অনুরোধের প্রেক্ষিতে ৫টি শর্তে গত ৪ এপ্রিল ডিএবিসহ ৫টি ফিলিং স্টেশনের নকশা সংশোধনের অনুমতি দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। বিপিসি চেয়ারম্যানকে দেয়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অপারেশন-১ অধিশাখার উপ-সচিব শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রের (ঙ) শর্তে উল্লেখ করা হয়, ‘এটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না এবং পরবর্তীতে প্রেরিতব্য মডেল ফিলিং স্টেশনের প্রস্তাবের পূর্বেই জমির সংস্থানসহ সুবিধাসমূহ পর্যালোচনা করে প্রস্তাব প্রেরণ করতে হবে।”
মডেল হলেও একেকটি ফিলিং স্টেশনের ডিজাইন একেক ধরনের কেন জানতে চাইলে বিপিসি ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মুখ খুলতে রাজি হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফিলিং স্টেশন অনুমোদন দেয়া বন্ধ। প্রভাবশালীরা চাইলেও ফিলিং স্টেশন বসাতে পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর সুযোগে মডেল ফিলিং স্টেশন নাম দিয়ে মূলত ফিলিং স্টেশনই অনুমোদন নিয়ে নেয়া হয়েছে। মডেল হলেতো আকৃতিগত ডিজাইন ও সুযোগ সুবিধা সব একই হতো। এখনতো একেকটি একেক ডিজাইনের। এখন মনে হবে একেকটি মডেল ফিলিং স্টেশনের মডেলই একেক ধরনের। তবে সুযোগ সুবিধাগুলো আগের সাধারণ ফিলিং স্টেশনগুলোর চেয়ে বেশি থাকবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ বেশ কয়েকবছর ধরে ফিলিং স্টেশনের অনুমোদন দেয়া বন্ধ রেখেছে বিপিসি। কিন্তু মুজিব শতবর্ষকে সামনে রেখে বিপিসি দেশে মডেল ফিলিং স্টেশন করার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল সেটি ইতিবাচক। কিন্তু মডেল মানে যেনতেন কোন প্রজেক্ট নয়, নিশ্চয়ই সবগুলো ফিলিং স্টেশন একটি ইউনিক ডিজাইন, আকার ও মানের হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মডেলের নাম দিয়ে ফিলিং স্টেশনগুলো একই ডিজাইনে নির্মিত হচ্ছে না। তাতে বুঝা যাচ্ছে, এখানে মুজিববর্ষ কোন বিষয় নয়, মুজিববর্ষের চেতনা কিংবা উদ্দেশ্যকে লালন করা হয়নি। প্রভাবশালীদের যেনতেনভাবে খুশি করতে ফিলিং স্টেশনগুলো দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি স্তরে অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এখানেও অবৈধ লেনদেন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে যেসব কর্মকর্তারা এসব মডেল ফিলিং স্টেশনগুলো অনুমোদন দিয়েছেন, যারা নজরদারি করছেন, তারা দায় এড়াতে পারেন না। অন্য অনিয়ম দুর্নীতির মতো এটাতেও হরিলুটের কাহিনী হয়েছে। এখানে মুজিববর্ষ একটি উপলক্ষ্য মাত্র।’
জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ২ হাজার ২৬০টি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামে ৩৬৮টি, ঢাকায় ৫৫৮টি, সিলেটে ১৪৪টি, ময়মনসিংহ ১২০টি, বরিশাল ৬৫টি, খুলনাতে ৩৩০টি, রাজশাহীতে ৩২৭টি, রংপুরে ৩৪৮টি ফিলিং স্টেশন রয়েছে। তন্মধ্যে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ৭০১টি, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ৮২৪টি এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ৭৩৫টি ফিলিং স্টেশন রয়েছে।
এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, একটি মডেল ফিলিং স্টেশনে ২.২৫ একর জমি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে নকশা অনুমোদনের সময় জমির দৈর্ঘ্য, প্রস্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। পরে এটি নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে জমির দৈর্ঘ্য প্রস্থ নির্ধারণ করে দিয়ে ঝামেলা তৈরি হতো না। এখন নির্মাণ পর্যায়ে এসে জমির আয়তনের কারণে মডেল ফিলিং স্টেশনের শর্ত অনুযায়ী স্থাপনাগুলোর স্থান এদিকওদিক করতে হচ্ছে। তবে মডেল ফিলিং স্টেশনের সুযোগ সুবিধাগুলো বিদ্যমান থাকছে।











