অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জন্ম ১৯২২ সালের ৬ জুলাই। সে হিসাবে কয়েক বছর আগেই তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। আর তাঁর মৃত্যু হয়েছে ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর। মৃত্যুর ২১ বছর পার হওয়ার পরও এতদাঞ্চলের জনগণের কাছে অধ্যাপক খালেদের নাম স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। সকল শ্রেণির মানুষের কাছে তাঁর গ্রহণ যোগ্যতা এখনো সর্বজনবিদিত। কারণ তাঁর পাণ্ডিত্য, সহজ সরল জীবনাচরণ সকলের কাছে এখনো অনুকরণীয়। তাঁর জীবনকে বিশ্লেষণ করলে আমরা তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্রকে নানাভাবে আবিষ্কার করতে পারি। এরকম বহুমাত্রিক চরিত্র সমাজে সত্যিই বিরল। একজন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক হিসাবে তিনি সর্বাধিক সমুজ্জ্বল। এই তিন চরিত্রের পৃথক পৃথক আলোচনায় তিনি সকলেরই একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এই তিন চরিত্রের বাইরেও রয়েছে তাঁর নানা ক্ষেত্রে সফল বিচরণ। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ পিতার মৃত্যুতে চট্টগ্রামে ফিরে এসে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক সমাপ্ত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের কর্মজীবন ও রাজনৈতিক জীবন শুরু ছাত্রাবস্থায়। দেশের স্বাধীকার ও প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। আর তাঁর কর্মজীবন ছিল বহুমুখী। তিনি ব্যবসা করেছেন, ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন, শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন বেশ কিছুকাল, আর সাংবাদিকতার সাথে ছিলেন আমৃত্যু। সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সৎ, নীতিনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি। তাঁর উজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবনে দেখা যায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৪৪ সালে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে রাউজান–হাটহাজারী সংসদীয় আসন থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন চট্টগ্রাম–৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই দেশের মুক্তিসংগ্রামে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করে ছিলেন। ১৯৭২ সালে বত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ সংবিধান কমিটির সদস্য হয়ে সংবিধান প্রণয়নে অবদান রাখেন। তিনি বাংলাদেশ সংবিধান প্রণেতাদের একজন এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। চট্টগ্রামবাসী হিসাবে এ আমাদের জন্য আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। বহু গুণে গুণান্বিত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন নিরহংকারী বিনয়ী মানুষ। উনার সঙ্গে দেখা করার জন্য বর্তমান নেতাদের মতো কোনো প্রটোকল লাগত না। এগুলোই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বর্ণাঢ্য দিক। যেগুলো বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দেখা মেলা বড়ই দুর্লভ। সাংবাদিক হিসাবেও তিনি অগ্রগণ্য একজন ব্যক্তিত্ব। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ১৯৬২ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দৈনিক আজাদীর সম্পাদক ছিলেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের বর্ণাঢ্য জীবন বিশ্লেষণে দেখা যায় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ যে সময়কাল পর্যন্ত আজাদীর সম্পাদক যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন তাতে তাঁর নিষ্ঠা ও দক্ষতার পরিচয় মেলে। তাঁর নিষ্ঠা ও দক্ষতার উদাহরণ এতদঞ্চলের সাংবাদিকতা জগতের মানুষের কাছে অবশ্যই অনুকরণীয়। তিনি সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর হাত ধরেই অনেকেই সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেছেন এবং তাঁর আদর্শকে ধারণ করে অনেকেই এখন সাংবাদিকতা জগতে আলো ছড়াচ্ছেন। পত্রিকার পাঠক সৃষ্টি করা বা পত্রিকাকে পাঠকমুখীতা করে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। আজাদীর এখন যে বিপুল জনপ্রিয়তা সেটা তাঁর হাত ধরেই। দীর্ঘদিন ধরে এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সোজা কথা নয়। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের আদর্শকে ধারণ করে আজাদীর এ পথচলা আমাদের গৌরাবান্বিত করে। তিনি যে সময়ে পত্রিকার হাল ধরেছিলেন সে সময় পত্রিকার পাঠক ছিলেন খুব কম। অনগ্রসর পাঠককে পত্রিকামুখী করে তুলতে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ভূমিকা অনন্য। তাঁর আদর্শকে ধারণ করে শুধু আজাদী নয় এতদাঞ্চলের অনেক পত্রিকা পাঠকের আস্থা অর্জন করেছে। সেজন্য সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্য তাঁর ভূমিকা চিরকালই অনুসরণীয়। তাঁর পথ ধরে এই অঞ্চলের সংবাদপত্র এগিয়ে গেছে বহুদূর। তিনি সংবাদপত্র জগতে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের কাছে যেন প্রশিক্ষণের এক পাঠশালা। কথায়–কাজে তিনি ছিলেন মহান একজন কর্মবীর। সংবাদপত্র জগতের সাথে জড়িতে সকলেই তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করবেন। একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন বটে, কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব গুণে সকলের নিকট তিনি একজন গ্রহণযোগ্য মানুষ ছিলেন। শিক্ষকতা জীবনেও তিনি দ্যুতি ছড়িয়েছেন। শিক্ষকতাকে ব্রত হিসাবে নেয়ার যে প্রত্যয়, তা তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। অসাধারণ বাগ্মিতা ছিল তাঁর অনন্য গুণ। দর্শক শ্রোতারা তাঁর বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ খালেকের অনুপ্রেরণায় তিনি আজাদীতে যোগ দেন। তাঁর পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতা সাংবাদিকতা জীবনে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিনি শিক্ষকতায় থাকেননি, কিন্তু থাকলেও তাঁর আরো সফলতা আমরা দেখতে পেতাম। সত্যি কথা– অধ্যাপক খালেদের মত ক্ষণজন্মা প্রতিভাবান মানুষেরা যখন যেখানে যতটুকু সময়ের জন্য যা পেশা হিসাবে নেন–সেখানেই সফলতা দেখাতে পারেন। এই জন্যই তিনি বহুগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। নিজের মধ্যে সাংবাদিকতা, রাজনীতি, শিক্ষকতার পাশাপাশি নানা সামাজিক–সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তিনি ছিলেন নেতৃত্বদানকারী একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর এতগুণের সমাহারের মধ্যেও তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারা স্বপ্লভাষী, নিরহংকারী, নির্লোভ, শুভ্র জীবনাদর্শের বিনয়ী একজন মানুষ। রুচিবোধে চিরায়ত বাঙালির প্রতিচ্ছবি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের জীবনাচরণ ছিল একেবারে সাদামাটা। সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা ছিল তাঁর নিত্যদিনের পোশাক। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের অগ্রপথিক।
লেখক
প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ