আজকাল বড্ড ক্লান্ত লাগে। বয়সটা বেড়েই চলেছে। পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও বেঁচে আছি। কী প্রকারে বেঁচে আছি জানি না। হয়তোবা কর্মই বেঁচে থাকা, কর্মই মুক্তি। ছুটে চলেছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চলার পথে হাজারো বিচিত্র সব মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। কথা হয় কখনো চোখে–চোখে, কখনোবা আকারে ইঙ্গিতে, আবার মাঝেমধ্যে বিজাতীয় ভাষায়।
নিজেকে আজকাল আত্মগোপনকারী সংকুচিত অনাথ শিশু বলেই মনে হয়। এইভাবে বেঁচে থাকাটা কেবলই হারানো মায়ের ক্ষয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকা। অনেকটা ভায়োলিনের ক্লেফ আর বেস–গিটারের ক্লেফ–এর সুরে বাঁধা জীবন।
তাত্ত্বিক আর দার্শনিকদের ব্যবহৃত ‘বিদেশি’ শব্দের চটচটে জবরজঙ্গতা– ‘ভবঘুরে’, ‘বাউণ্ডুলে’, ‘যাযাবর’, ‘দেশত্যাগী’, ‘প্রবাসী’, ‘অভিবাসী’, ‘শরণার্থী’, ‘রিফিউজি’, ‘গুক্স বা অশ্বেতাঙ্গ বিদেশি’, ইত্যাদি নানান ধরনের পরিভাষা আমার স্নায়ুতন্ত্রের উপরে চেপে বসায় আমি বিভ্রান্ত এবং আতঙ্কিত, যেহেতু এসবই যুক্ত হয়ে আছে একটি ব্যাসের মধ্যে যা চক্রবৎ। অতএব, আমি একদিকে যেমন বিপন্ন বিশ্বাসঘাতক, অন্যদিকে নির্ভীক এবং দুর্বিনীত দুর্দান্ত ডানপিটে। এক কথায় যদি বলি তবে বলতেই হয়, আমি মানুষটা এড়ো পথের বাসিন্দা যেখানে আশা ও সংগ্রাম যুক্ত হয়ে আছে একত্রে। আমি যেন শিল্পী নিকোলা পুসাঁ–র ক্যানভাসে আঁকা দৃশ্যমান চরিত্রগুলোর একজন–
আমাকে যে তাই করতে হয়
ওরা যা চায়,
যদিওবা চাই না ‘আমি’।
‘আমি’– ‘আমি’ যে অন্য কোথাও।
‘আমি’ যে কারো নই,
‘আমি’ আমারও নই।
এসব এলোমেলো ভাবনাগুলো যখন মস্তিষ্কের কোটরে ছুটোছুটি করছিল, আমি তখন ‘ভেগা–ওমেগা’ জাহাজটির যাত্রী। ভেসে চলেছি ক্যারিবিয়ান সাগরে। বন্দর থেকে বন্দরে। যাত্রার শুরু জ্যামাইকার ‘কিংস্টন’ বন্দরে। শেষ গন্তব্যস্থান বারবাডোজের ‘ব্রিজটাউন’ বন্দর। মাঝপথে হাইতির ‘পোর্ট–অ–প্রিন্স’ বন্দরে দুই দিনের বিরতি। যাত্রাপথের বন্ধু বলতে হ্যাভারস্যাক, ল্যাপটপ, দুটো বই– Jacques Rouman-Gi ‘Master of Dew’ Ges Colin Channer–এর ‘Waiting in Vain’, আর প্রিয় সব সংগীত শিল্পী বব মার্লে, পিটার তোশ, ডেনিস ব্রাউন, মাভাডো, রিতা মার্লে এদের সব সিডি। এদের এই সিডিগুলো আমি সংগ্রহ করেছিলাম কিংস্টন শহরের ‘ভিলেজ প্লাজা’–র দোকান ‘কোয়ান্টাম কনসেপ্ট’ থেকে।
জাহাজের ডেকের এক কোনায় আমার শোবার ও বসার জায়গা। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। ধীরে ধীরে সযত্নে মাথাটা হ্যাভারস্যাকের উপর রেখে, কানে হেডফোন লাগিয়ে বব মার্লের ‘রিডেম্পশন’ গানটি শুনছিলাম। গানের মূল বিষয়টি মুক্তির আনন্দ–
Emancipate yourselves from mental slavery,
…Won’t you help to sing
These songs of freedom?
মুহূর্তের মধ্যে গানের সুর আর কথা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল কিংস্টন শহরের ইমানসিপেইশন পার্কের মূল ফটকের কাছে; যেখানে দাঁড়িয়ে আছে লৌরা ফেসি–র স্মারক ভাস্কর্য ‘রিডেম্পশন সং’। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মুক্তির গান’। দুটো কালো মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুক্তির শ্বাস নিচ্ছে। আমি বিস্ময়াভিভূত। ওরা যে আমারই কথা বলছে, আমার ভবিষ্যতের কথা বলছে, আমার পূর্বপুরুষের মুক্তি ও সংগ্রামের কথা বলছে। মুহূর্তের মধ্যে আমিও যে ওই মানুষদুটোর একজন হয়ে উঠলাম–
দীর্ঘ নিরবতা
মৃতদের স্তূপ
ক্লান্তিহীন ঘুম।
জীবিত আর মৃতরা
জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে
রক্তের ভেতর!
বিতৃষ্ণা নয়,
নয় কোনো ঘৃণা।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই
আমরা মারা যাবো।
কেউ কি আছো ওখানে?
উঠে পড়ো… বিউগল বাজছে।
অজানা অপরিচিত সব মুখ
কী ভীষণ নীল!
এটা কি দ্বিতীয় ঝড়?
নাকি তৃতীয়
নাকি চতুর্থ
নাকি শত সহস্র সংখ্যাহীন
অগণনীয় অগুনতি ঝড়?
লাশগুলো উঠে দাঁড়াচ্ছে।
আমিতো ভেবেছিলাম শুধু জীবিতরাই ওখানে আছে।