মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যেন নয় যুগ। স্মৃতির গভীরে মৃত প্রায় ঘটনাগুলো বার বার শুনাতে চাচ্ছে সুদীর্ঘ কোনো ইতিহাস। যেনো বলতে চাইছে ‘তোমরা কি আমাকে ভুলে গেলে? আমিতো তোমাদের লাল সবুজ পতাকার সাক্ষী। তবে কেনো তোমরা আমাকে স্মৃতির অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছ’? আসলে এই নয় মাসের কথা কেউই কখনো ভুলতে পারে না। আমিও না।
আজকে আমার খুব লিখতে ইচ্ছে করছে একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা। তারা ছিলেন সৎ এবং প্রচার বিমুখ। আমার আম্মার ছোট বোন থাকতেন ব্রাহ্মণবারিয়া। খালু ছিলেন ব্রাহ্মণবারিয়ার স্টেশন মাস্টার। ফাগুনের একটা খুব ঝকঝকে দিন। দখিনা হাওয়া বার বার জানান দিচ্ছে ‘আমি আছি’। কিন্তু চারদিকে থমথমে পরিবেশ। পাকবাহিনী ঢাকায় নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হত্যা করছে অগনিত মানুয। এর প্রতিবাদের ছোঁয়া লেগেছে অন্য জেলাগুলোতে।
আমার খালার শ্বশুরবাড়ি ছিল আখাউরা। ওনারা সবাই আখাউরার গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখান থেকে তারা শরণার্থিনী হয়ে আগরতলা পৌঁছেন। খালু সাহস নিয়ে ট্রেন চালিয়ে ট্রেনটি আগরতলা নিয়ে যান। খালু এবং তাঁর ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। আমার দুই খালাত ভাইয়ের একজন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে,
অন্যজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পড়তেন। আর দুইবোনের একজন ৭ম শ্রেণির, আরেক জন ৬ষঠ শ্রেণির ছাত্রী। ওদের বয়স কম বলে নার্সিং ট্রেনিং দেয়া হয়। ওদের ক্যাম্প এর নাম ছিল–আগরতলার উদয়নগরের ভজনগর ক্যাম্প। শরণার্থী শিবিরে সবাইকে চাল ডাল আর ৫০ টাকা দেয়া হত। খালু আর তাঁব ছেলেরা
আর্মি হোলডিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিচ্ছিল। ট্রেনিং শেষে তাঁরা কসবা উপজেলার সালদা নদী, কোল্লাপাথর ও কুটি রণাঙ্গনে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর দুইবোন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় ব্যস্ত। ফিরে আসে সেই কাঙখিত দিন। যে রেসকোর্স ময়দানে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার
বজ্রকণ্ঠ। নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তি যুদ্ধের পর ৭১‘এর ১৬ ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেলে ইতিহাসের আর এক নতুন অধ্যায় রচিত হলো। স্বাধীনতার সূর্য বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জায় নবতর শপথে বাংলার আকাশে উদিত হল। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সুন্দর এক সকালে ফিরে এলো খালার পরিবার। খালু আখাউড়া জংশনের স্টেশনমাস্টার হিসেবে যোগদান করেন। আমার খালুর নাম জায়েদুল হোসেন খান। দুইভাইয়ের নাম জাকির হোসেন খান, তানভীর হোসেন খান। ওনাদের সবারই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ছিলো। কিন্তু তাদের নাম মন্ত্রালয়ে দেয়া হয় নি। ওনারা
তিন জনই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না নিয়েই পরপারে যাত্রা করেছেন। খালাত বোন ছোট জন (খুরশীদ বেগম) আমেরিকা প্রবাসী। বড়বোন সামসাদ বেগমের নাম ২০১৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা লিস্টে দেয়া হয়। ২০১৯ সালে তাকে ঢাকায় সম্মাননা দেয়া হয়।