আমাদের দেশ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। যে যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেকেই। অনেকেই হারিয়েছেন তাঁদের মূল্যবান সহায়–সম্পদ। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বাঙালির ওপরে যে অত্যাচার করেছিল, তা বর্ণনাতীত। অনেক ত্যাগ–তিতিক্ষার বিনিময়ে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল নতুন রাষ্ট্র, নতুন মানচিত্র ‘বাংলাদেশ’। তাই ১৯৭১ সাল বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
আমাদের স্বাধীনতার জন্যে যে যুদ্ধ, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধ কেন করতে হয়েছিল আমাদের?
ভারত ছিল অবিভক্ত। ১৯৪৭ সালে তাকে দু’ভাগ করে আলাদা দু’টি দেশ সৃষ্টি করা হয়। একটার নাম ‘পাকিস্তান’, অন্যটা ‘ভারত’। পাকিস্তানের আবার দু’টি অংশ। একটা পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটা পশ্চিম পাকিস্তান। দেশ এক হলেও পশ্চিম পাকিস্তান সবসময় পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতো, যেখানে বাস করি আমরা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের লোকজনকে নানাভাবে শোষণ করে গোলাম বানিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকতো। এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের মাতৃভাষার ওপর হস্তক্ষেপ ঘটনায়। পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও তাদের মাতৃভাষা ‘বাংলাকে’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। সেই সময়ে রাষ্ট্রনায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র এই ঘোষণার প্রতিবাদ জানান আমাদের টগবগে ছাত্র সমাজ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পালন করা হয় প্রথম ভাষা দিবস। পরবর্তী সময়ে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলনে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বুকে গুলি চালানো হয়। এতে শহীদ হন রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে। রক্ত দিয়েই আমাদের ছাত্র সমাজ রুখে দিলো বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সমস্ত ষড়যন্ত্র। আমাদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরী হতে থাকে।
১৯৫২ সালের পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের পূর্ব বাংলার মানুষকে নতুনভাবে শোষণের চেষ্টায় মেতে উঠলো। পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের চা, চামড়া, পাট ইত্যাদি দিয়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় উন্নত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানকে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হলো পূর্ব বাংলার জনগণ। ধীরে ধীরে আন্দোলন তীব্রতর হতে লাগলো। শুরু হলো একটার পর একটা প্রতিরোধ। ১৯৬২ সালে সংঘটিত হলো শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে হলো ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে হলো গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে তৎসময়ের ফিল্ড মার্শাল হিসেবে খ্যাত আইযুব খানের বিদায় হলে ক্ষমতায় এলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
ইয়াহিয়ার আমলেই অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। নিয়ম অনুযায়ী পাকিস্তানের শাসনভারের অধিকারী হওয়ার কথা আওয়ামী লীগ প্রধান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তাঁকে ক্ষমতা দেয়া হলো না। পাকিস্তানি শাসকরা মেতে উঠলো নতুন ষড়যন্ত্রে। তাদের সেই ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তড়িঘড়ি করে ঢাকায় আসেন আলোচনার উদ্দেশ্যে। আলোচনার প্রসঙ্গ হচ্ছে লোক দেখানো। মূল উদ্দেশ্য ছিল সময়ক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানি করা। পূর্ব বাংলার লোকেরা আলোচনা থেকে একটা শুভ সংবাদ প্রত্যাশা করেছিল; মনে করা হলো এবার হয়তো আমাদের দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোথায় শুভ সংবাদ? তার বদলে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্যাঙ্ক, কামান, রকেট ও নানা ভারী অস্ত্র নিয়ে হঠাৎ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের আক্রমণে প্রথম রাতেই মারা যায় অসংখ্য নারী–পুরুষ। আক্রমণ হঠাৎ হওয়ায় প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি পূর্ব বাংলার লোকজন। পরে বুঝতে পেরে বীরত্বের সঙ্গে তারা প্রতিরোধে নামে। ২৬ মার্চ কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্ল্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান ও পরে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সাধারণ জনতা একযোগে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়া গ্রামে (বর্তমান নাম মুজিবনগর) স্বাধীনতার সনদ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠনিকভাবে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই সরকার প্রধান নির্বাচন করা হয়।
এরপর সশস্ত্র যুদ্ধ আরো দৃঢ় হয়। একটার পর একটা হামলা–আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে এদেশের দামাল ছেলেরা। ১৯৭১ সালে ৩রা ডিসেম্বর ভারত সরাসরি আমাদের সহায়তায় নামে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণের সঙ্গে আপামর জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা যুক্ত হলে পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। পর পর হামলায় দু’চোখ যখন অন্ধ, তখন ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির হাজার প্রাণের অগ্নি তরুণদের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের পরাজয়ে উদিত হয় একটি নতুন দেশের সূর্য। সূচিত হয় নতুন ইতিহাস। আমরা পাই স্বতন্ত্র ভূখণ্ড, সার্বভৌম জাতিসত্তা, নতুন দেশ। তার নাম বাংলাদেশ।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত সেই ‘মুক্তিযুদ্ধই’ আমাদের শ্রেষ্ঠ গৌরব ও অহংকার। এই অহংকারের স্বতন্ত্র চিত্রায়ন ঘটেছে আমাদের শিল্প–সাহিত্যের নানা শাখায়, নানা প্রশাখায়, কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, চলচ্চিত্রে। আমাদের শিল্পী–সাহিত্যিকরা তাঁদের লেখায় রেখায় তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ চিত্র, ব্যক্ত করেছেন আগুন ঝরা দিনের কথা, লিপিবদ্ধ করেছেন বীরত্ব ও গৌরবগাথা।
মুক্তিযুদ্ধের পর সাহিত্যের নানা শাখায় বেশ কাজ হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ব্যক্তিগতভাবে আমিও সামান্য চেষ্টা করেছি মহান স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে অনুষঙ্গ করে কিছু রচনা তৈরি করতে। নিজের মৌলিক লেখার বাইরে প্রথম সম্পাদনা করি ১৯৯৭ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের ছড়া ও কবিতা’। এছাড়া নেছার আহমদের সঙ্গে সম্পাদনা করি ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’ (২০২১), জাহাঙ্গীর মিঞার সঙ্গে সম্পাদনা করি ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর’ (২০২২), এস এম মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে সম্পাদনা করি ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা’ (২০২২), গৌতম কানুনগোর সঙ্গে সম্পাদনা করি ‘ভালোবাসায় শেখ রাসেল’ (২০২২), মুহাম্মদ মহসীন চৌধুরীর সঙ্গে সম্পাদনা করি ‘জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধু’ (২০২৩) এবং আমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত সংকলন হলো ‘কীর্তিগাথা’ (২০২২)। নিজের লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে : স্বাধীনতার প্রিয় কবিতা (২০০০), ভাষা–আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধ–স্বাধীনতা ও দেশের কবিতা (২০১৪), তীর্থভূমি (২০১৭), খোলা আকাশের দিন (২০১৬), কী শোভা কী ছায়া গো (২০১৭), বীরের স্বপ্ন (২০১৮), বঙ্গবন্ধু তুমি অজর অমর (২০১৯), দশ দিগন্তে বঙ্গবন্ধু (২০২১)।
এসব রচনায় কমবেশি প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় নানা আখ্যান, ধ্বনিত হয়েছে শৌর্য–বীর্যের প্রদীপ্ত অহঙ্কার, উন্মোচিত হয়েছে বাঙালি জাতির স্বরূপ–চেতনা; রূপায়িত হয়েছে যুদ্ধ দিনের বিচিত্র অনুষঙ্গ। ‘সন্ত্রাসবন্দি বুলেটবিদ্ধ দিন রাত্রি’র ভয়াল চিত্র, অবরুদ্ধ মানুষের নির্বাক আহাজারি, অসহায়ত্বের গোঙানি, হানাদার বাহিনীর হত্যা, লুট, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, শহীদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, স্বপ্ন, প্রাপ্তি—সব কিছুই যেন উজ্জ্বল ও ছবির মতো স্পষ্ট ও জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এসব রচনায়। আমরা মনে করি, আমাদের এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শৈল্পিক ফসল, বাঙালি চেতনা–বোধের রক্তিম অনুরণন।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।