মীরসরাইয়ে এক দশকে কমেছে ২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি

অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানা স্থাপন

মীরসরাই প্রতিনিধি | শনিবার , ২৮ জুন, ২০২৫ at ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

মীরসরাই চট্টগ্রামের কৃষিসমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। দুটি পৌরসভা ও ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলাটিতে ২০০৯১০ সালেও কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫০৫ হেক্টর। তবে এখন তা (কৃষিজমি) কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ হেক্টরে। অর্থাৎ এক দশকে কৃষি জমির পরিমাণ কমেছে ২ হাজার ১০৫ হেক্টর। কারণ হিসেবে জানা যায়, একটি চক্র কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে এসব জমি প্রথমে কিনে নিচ্ছে। পরে ঢাকাচট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্প গ্রপের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছে। আর শিল্প গ্রুপগুলো এসব কৃষিজমিতে নির্মাণ করছে কারখানা। এছাড়াও অনেক কৃষিজমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন, ফিলিং স্টেশন, ইটভাটা ও ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। যার কারণে কৃষিসমৃদ্ধ এই অঞ্চলটিতে ক্রমেই কমছে আসছে কৃষিজমি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি শিল্প গ্রুপগুলো কৃষিজমিতে কারখানা নির্মাণ অব্যাহত রাখে তাহলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। এছাড়া পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এখানে। রয়েছে একটি বিসিক শিল্পনগরীও। অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে এখনো কয়েক হাজার একর জমি খালি পড়ে রয়েছে। তবু ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কৃষিজমিতে একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পকারখানা। এতে দিন দিন কমছে কৃষিজমি। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি কৃষিজমি কমেছে উপজেলার করেরহাট ও ইছাখালী ইউনিয়নে। ইছাখালী ইউনিয়নে ১০ বছর আগে কৃষিজমি ছিল ৩ হাজার ২০০ হেক্টর। এখন রয়েছে ২ হাজার ৮০০ হেক্টর। গত ১০ বছরে ওই ইউনিয়নে কৃষিজমি কমেছে ৩০০ হেক্টর। অন্যদিকে করেরহাট ইউনিয়নে ১০ বছর আগে কৃষিজমি ছিল ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর। সেখানে এখন আবাদি জমি রয়েছে ১ হাজার ৫০০ হেক্টর। তবে ২০২৪ সালে চলতি বছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কী পরিমাণ কৃষিজমি কমেছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, মীরসরাই কৃষিসমৃদ্ধ উপজেলা হলেও দিন দিন জমির পরিমাণ কমছে। এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি, কৃষিজমিতে বসতবাড়ি, শিল্পকারখানা নির্মাণ ও স্থাপন।

প্রায় ২২ হাজার একর জমিতে মীরসরাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে এরই মধ্যে আটটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। অবকাঠামো নির্মাণ করছে কমপক্ষে ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এখনো অনেক জমিই খালি রয়েছে। মীরসরাই সদরে রয়েছে প্রায় ১৫ দশমিক ৩২ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত বিসিক শিল্পনগরী। সেখানে ৮০ জন উদ্যোক্তাকে ৮৮টি প্লটও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। তবে এখনো ৫৯টি খালি পড়ে রয়েছে। বিভিন্ন সমস্যার অজুহাতে উদ্যোক্তরা শিল্পকারখানা নির্মাণ করছে না। অথচ কৃষিজমিতে স্থাপন করা হচ্ছে কারখানা। এ বিষয়ে বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মোহাম্মদ তানজিলুর রহমান বলেন, মীরসরাই বিসিক শিল্পনগরীতে বর্তমানে আটটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে রয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সমস্যার কারণে উদ্যোক্তরা কারখানা নির্মাণে বিলম্ব করছেন।

সরেজমিন করেরহাট ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, জয়পুর পূর্ব জোয়ার মৌজায় ২৫ একর তিন ফসলি জমিতে বিদ্যুতের সাব স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও ওই সময় স্টেশনটি নির্মাণের বিরোধিতা ও আন্দোলন করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। করেরহাট ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা জানান, ১৪৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ইউনিয়নে তিন একর কৃষিজমিতে পিএনজি বিডি লিমিটেড, ১৫ একর কৃষিজমিতে সিপি বাংলা কারখানা স্থাপন করেছে। এছাড়া কহিনূর কেমিক্যাল নামে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ১৫ একর কৃষিজমি কিনে নিয়েছে। প্রায় ৫৫ একর কৃষিজমিতে পাঁচটি ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া কৃষিজমিতে রয়েছে কয়েকটি ফিলিং স্টেশন। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাপাহাড় এলাকায় প্রায় ৪৫০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বিএসআরএম বিলেট (রড উৎপাদনের মধ্যবর্তী কাঁচামাল) কারখানা। রয়েছে ওমেরা গ্যাসের কারখানাসহ বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান। খৈয়াছড়া ইউনিয়নের পূর্ব খৈয়াছরা, বড়তাকিয়া, ওয়াহেদপুর ইউনিয়নসহ মহাসড়কের পাশে কৃষিজমি কিনে সাইনবোর্ড সাটিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে ভবিষ্যতে করেরহাট ইউনিয়নের মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে।

উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য বলছে, গত ২০০৯১০ সাল পর্যন্ত মীরসরাইয়ে ৯ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে আউশ, ২১ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে আমন ও ২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছিল। ২০২৪২৫ সালে ৫ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আউশ, ১৭ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে আমান ও ১ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। সে হিসাবে দেড় দশকে আউশের আবাদ ৩ হাজার ৪০০ হেক্টর, আমান ৩ হাজার ১৮০ হেক্টর ও বোরো আবাদ কমেছে ৭২০ হেক্টর জমিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের দুইতিন ফসলি জমি নানাভাবে অকৃষিকাজে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ আইনে কৃষিজমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। কিন্তু সে আইনের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) মাঠ কর্মকর্তা ফারমিন এলাহি বলেন, দেশে দিন দিন কৃষিজমি কমছে। যদি শিল্প গ্রুপগুলো কৃষিজমিতে কারখানা নির্মাণ অব্যাহত রাখে তাহলে ভবিষতে এ অঞ্চলে খাদ্য সংকট দেখা হবে। এছাড়া পরিবেশের ওপর মারত্মক প্রভাব পড়বে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইমাম হোসাইনের (রা.) আদর্শে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে দুর্ঘটনার কবলে মীরসরাইয়ের এসিল্যান্ড