মীরজাফরদের চিহ্নিত করা অনেক কষ্টসাধ্য কাজ

আয়েশা পারভীন চৌধুরী

| শুক্রবার , ৩ মে, ২০২৪ at ৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি উল্লেখযোগ্য দিক। পলাশীর আম্রকাননে আমরা একটা স্বাধীন জাতি থেকে পরাধীন জাতিতে পরিণত হই। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা আপন কয়েক জনের ষড়যন্ত্রে সেদিন পরাজয় বরণ করে। আর নবাবের একান্ত আপনজনের ষড়যন্ত্রের ফলে স্বাধীনতার সূর্যটি ইংরেজরা সেদিন ছিনিয়ে নিতে পারে। পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের ময়দানে মীরজাফরের নির্দেশে ১০০ হস্তি বাহিনীকে দাঁড়িয়ে রাখা হয়েছিল। ৫০ হাজার পদাতিক বাহিনী চুপচাপ বসেছিল। অথচ মীরমদন বীরদর্পে ৩০০০ বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সৈন্যরা যখন জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল মীরজাফর তখন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে ভুল তথ্য দিয়ে যুদ্ধ বন্ধের আহ্‌বান জানায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মীরমদনকে মেরে ফেলা হয়। মোহন লাল নবাবকে আসল ঘটনা খুলে বললে তখন আর কোনও কিছু করার ছিল না। ইতিমধ্যে সব কিছু শেষ হয়ে যায়। মীর জাফরের চক্রান্ত ও হটকারিতায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। এরপর ২০০ বছরের ইংলিশ শাসন চলতেই থাকে। নবাবের সরলতার সুযোগে ও মীর জাফরের সহায়তায় ইংরেজরা জয় লাভ করে। আপন মানুষগুলো যদি সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তাহলে কখনোই ইংরেজরা সুবিধা করতে পারতো না। বাঙালি সাহসী জাতি। প্রবল প্রতিবাদী। কিন্তু এদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পরাধীনতার শৃংখল মেনে নিতে হয়েছে। মীরজাফরের মতো একেবারে ঘনিষ্ঠ ও পরমাত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সেদিন ইংরেজরা জয় লাভ করে। জনসাধারণের সমর্থন ও বিশাল সেনাবাহিনীর ঐকান্তিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও মীরজাফরদের হঠকারিতায় বাংলার ইতিহাসে পরাধীনতার কলঙ্ক দাগ লেগে যায়। ২০০ বছরের ইংলিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিরা বার বার মাথা তুলে প্রতিবাদ করে। আন্দোলন সংগ্রাম করে। কিন্তু তখনো মীরজাফরের বংশধরেরা যারা ইংরেজের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল তারা বাঙালিদের সংগ্রামী সব আন্দোলন সংগ্রামের তথ্য সরবরাহ করে আসতো। নিজের ঘরে যখন শত্রু থাকে তখন সব প্রতিবাদ সংগ্রামগুলো বাধা প্রাপ্ত হয়। তবুও বীর বাঙালিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এক এক সময় এক এক ভাবে তাদের প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার দল সকল ধরনের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। ইংরেজদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দেশ ও সাধারণ মানুষের সব ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। এভাবে পরাধীনতার শৃংখল নিয়ে বীর বাঙালিরা প্রায় ২০০ বছর কাটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের শাসন থেকে বাঙালিরা মুক্তি লাভ করে।

প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়। ধাপে ধাপে গোপনে ও প্রকাশ্যে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। প্রাচুর্য ভরা এই বাংলার জনপদের প্রতি ছিল ইংরেজদের প্রবল লোভ লালসা। বাঙালিদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা এই উপমহাদেশে তাদের ঘাটি শক্ত করতে থাকে। তাদের সাথে হাত মেলায় বাংলার কতিপয় সুযোগ সন্ধানী বিবেকহীন মীরজাফর। পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। মীরজাফর ও তার সহযোগীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল ঠিক তেমনি ইংরেজদের শাসনকে আরো বেশি জোরদার করতে কতিপয় বাঙালি সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিদেরও সহযোগিতা ছিল বেশি। অত্যাচারী ইংরেজিদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এইসব সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিরা ইংরেজদের নানাভাবে সাহায্য করে। নিজের দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে তাদের এক বিন্দু বিবেক কাঁপেনি। সাময়িক কিছু সুযোগ সুবিধার বিপরীতে তারা নিজেদের অস্তিত্বকে বিলিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে নাই। যারা এই সকল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য এগিয়ে আসে তাদেরকে নিশ্চিন্ত করার জন্য ইংরেজরা চেষ্টা চালিয়ে যায়। মীরজাফরের বংশধর ইংরেজদের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার আশায় কাজ করেছে কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধকে অস্বীকার করতে পারে না। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরদেরকে একসময় চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ইংরেজরা এই সকল সুযোগ সন্ধানীদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিল। তারা শেষ পর্যন্ত কোনও সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে পায়নি। এ ধরনের দেশদ্রোহীদের শাস্তি হিসেবে ইংরেজরা তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছে। বাংলার ইতিহাসে তারা ঘৃণিত ও কলঙ্কিত। ইতিহাস তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবে না। হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা সরাসরি জড়িত ছিল তাদের সকলের মৃত্যু ছিল ভয়ংকর। ইতিহাস থেকে জানা যায় ; তাদের সকলেই বিভিন্নভাবে অপমৃত্যু বরণ করে। তাদের বিভিন্ন অপঘাতেই মৃত্যু হয়েছে। কেউ নিজের গলায় ছুরি চালিয়েছে ; কেউ পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে এবং কাউকে কাউকে ইংরেজরা নদীতে ফেলে হত্যা করেছে। মীরজাফর ও তার সহযোগীদের করুন মৃত্যু হলেও বিশ্বাসঘাতকের গ্লানি থেকে মুক্ত হয় তাদের বংশধর। মীরজাফরের বংশধর নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখে। সমাজ ও রাষ্ট্রে এখনো ঘৃণিত। যতদিন যাবে ততদিন তারা এই গ্লানি বয়ে বেড়াবে। যুগের পর যুগ একটি অভিসপ্ত জীবন যাপন করছে। বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানির লজ্জায় আত্মগোপন করে থাকে। মীরজাফরের একজন বংশধর এক সাক্ষাৎকারে তাদের এই করুন অবস্থা তুলে ধরে। বিশ্বাসঘাতকের অভিশাপ বড়ই ভয়ানক। বিশ্বাসঘাতকতা শুধু শেষ ও ধ্বংস করে না তার বংশধরকেও তিলে তিলে নিশ্চিহ্ন করে। মীরজাফরকে ইতিহাসের গাধা হিসেবে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এনে দিয়েছে সম্মানের উচ্চ আসন। বাংলার মানুষের হৃদয়ে ও ইতিহাসের পাতায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা অমর হয়ে আছে।

আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জড়িয়ে আছে। বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে দুইটি ঐতিহাসিক স্থানের একটি অদ্ভুত মিল দেখা যায়। পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতন ঘটে। মীরজাফরের হটকারিতার ফলে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় আবার মেহেরপুরের আম্রকাননে সূর্য সন্তানদের অদম্য সাহসিকতার মাধ্যমে স্বাধীনতা সূর্য উদিত হয়। এই দুজনের আরও একটি মিল হচ্ছে একান্ত আপন জনের হটকারিতার কারণে উনাদের মৃত্যু ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের সংবাদ পান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতে পারেন নাই। বঙ্গবন্ধু বলেন; আমার সন্তানরা কোনদিন আমাকে হত্যা করতে পারে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের আখের গোছানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট সকাল বেলায় সপরিবারে হত্যা করা হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যাকারী মীরজাফর এবং তার বংশধরদের করুণ পরিণতির ইতিহাস সবাই জানেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল দেশবিদেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদেরকে পাকাপোক্ত করতে থাকে। যেখানে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাহস পায় নাই। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা ক্ষান্ত হয় নাই তাঁকে নির্বংশ করার জন্য পরিবারের আরো ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় ; যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তারা পরবর্তী সরকার কর্তৃক বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত হয়েছিল। যারা হত্যা করেছে তাদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে অলংকৃত করা হয়। প্রায় ৪৫ বছর পরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কয়েকজনকে ফাঁসির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার কলংক কিছুটা মুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো কয়েকজন দেশের বাহিরে অবস্থান করছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা হত্যাকারী সেই মীরজাফরদেরকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে। এই জাতি দায়মুক্ত হবে। আমাদের আশেপাশে আত্নগোপনে থাকা মীরজাফরদের চিহ্নিত করা অনেক কষ্ট সাধ্য। তারা সব সময় ওত পেতে রয়। জনগণের ক্ষতি করতে যেমন কুন্ঠাবোধ করে না ঠিক তেমনি দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে এক বিন্দু চিন্তা করে না। মীরজাফরদের কাছে জনগণ বড় নয়। দেশ প্রধান নয়। তাই সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ মীরজাফর প্রতি পদে পদে প্রতি ক্ষনে ক্ষনে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।আমরা আর ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের মত ঘটনা দেখতে চায় না।

লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডাঃ ফজলুলহাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগও
পরবর্তী নিবন্ধচাকরির প্রলোভনে পতিতাবৃত্তি দুই নারী উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৪