বাইশদিন। জ্বি, একটানা বাইশদিন সমুদ্রপাড়ি দিয়ে ব্রাজিল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে এসে পৌঁছাতাম। একভাবে চিন্তা করলে খুবই মজার অভিজ্ঞতা, আবার অন্যভাবে দেখলে একঘেঁয়ে কষ্টের জীবন, যে যেভাবে নেয়। কিন্তু সেটাই ছিলো আমার এগারো মাসের রুটিন। বাইশদিন টানা ব্রাজিল থেকে মধ্যপ্রাচ্য; আবার ফিরতি পথে বাইশদিন। আমি বলছি সেই ১৯৮৭/৮৮-এর কথা। তখন আমি বৃটিশ মালিকানাধীন একটা রিফার জাহাজে (reefer ship) কাজ করতাম।
রিফার জাহাজ মানে refrigerated ship এই জাহাজের সব মালামালই ফ্রোজেন বা ঠান্ডা রাখতে হয়। আমার জাহাজের নাম ছিলো মিস্ট্রাল (M.V. Mistral)। M.V. মানে হলো Motor Vessel মানে যেই জাহাজ মোটর ইঞ্জিন দিয়ে চলে। আগেকার যুগে ছিলো ঝঝ (Steam Ship), এখন হয়েছে গঠ অথবা গঞ – ট্যাঙ্কারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমাদের লোডিং পোর্ট ছিলো ব্রাজিলের প্যারানাগুয়া। সেখান থেকে কলা, চিকেন এবং কন্ড বীফ নিয়ে ওমান, দুবাই, সারজাহ, আবু-ধাবী, বাহারাইন, কুয়েত, সৌদি আরবে যেতাম সেগুলোকে সরবরাহ করতে। মানচিত্র দেখলেই বুঝতে পারবেন, আমরা ব্রাজিলের বন্দর প্যারানাগুয়া থেকে পূর্বদিকে রওনা দিয়ে আড়াআড়িভাবে দক্ষিণ অ্যাটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উত্তামাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) দিয়ে ঘুরে, মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিকের মাঝের মোজাম্বিক-চ্যানেল পার হয়ে একটু তেরছাভাবে উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে চালিয়ে আরব সাগরে পড়ে ওমান চলে আসতাম। তারপরে হরমুজ প্রণালী পার হয়ে পারস্য উপসাগরে যেয়ে, সেখানের অনেকগুলো পোর্টে থামতাম কার্গো ডিসচার্জ করতে। মাঝে মাঝে সাউথ আফ্রিকার কেপটাউন, পোর্ট-এলিজাবেথ, ডারবানেও থামতাম, মালামাল নামাতে।
বর্তমান যুগের অনেক কন্টেইনার জাহাজে রেফ্রিজেরেটেড কন্টেইনার ব্যবহার হয়, যেগুলো জাহাজে উঠানোর পরে ইলেক্ট্রিক্যাল কানেকশান দিয়ে দিলে নিজে নিজেই ঠান্ডা থাকে। সেই কন্টেইনারই আবার পোর্টে আসলে ট্রাকের পিছে বেঁধে গন্তব্যে নিয়ে চলে যায় কন্টেইনারের ভিতরে ফ্রিজ কিন্তু তখনো চলছে। কিন্তু আগেকার যুগে তো সেরকম ছিলো না। আমার সেই জাহাজ, মিস্ট্রাল কিন্তু কন্টেইনার শিপ ছিলো না, সেই জাহাজের প্রত্যেকটা খোলই (বা কার্গোহোল্ড) ছিলো রেফ্রিজেরেটেড। কার্গোর হিসাবে হোল্ডগুলোর তাপমাত্রা ঠিক রাখতে হতো। চিকেন বা কর্ণড্ বিফ বা মাটন নিয়ে অসুবিধা নাই। সেগুলো ফ্রোজেন কার্গো কার্গোহোল্ডের টেম্পেরাচার শূন্যের অনেক নীচে একবার নামিয়ে, তারপরে সেরকম রেখে দিলেই হলো। মাংসগুলো সব জমে বরফ হয়ে থাকতো। শুধু খেয়াল রাখতে হতো বাতাসের আর্দ্রতার কারণে যাতে বেশী বরফ জমে জমে সবকিছু আটকে না দেয়। তবে সবচেয়ে সেনসিটিভ ছিলো কলা বা অন্য যে কোনো ফল, শাকসব্জী সেগুলোকে live cargo বলে। (অবশ্য কিছু জাহাজ আছে, Cattle carrier, সেগুলোই আসল লাইভ-কার্গো বহন করে গরু-ছাগল-দুম্বা ইত্যাদি)। যাহোক, আমাদের মিস্ট্রালের কলা কার্গোর জন্য বাতাস-অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়; বলা যায় একপ্রকার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করে দিতে হতো তাদের জন্য। সেগুলো এতই নাজুক যে, তাপমাত্রা দুই এক ডিগ্রি এদিক ওদিক হলে কয়েক ঘন্টার মাঝেই সব কার্গো নষ্ট হয়ে যাবে। হাজার হাজার টন কলা নষ্ট হলে যে, কীরকম খেসারত সেটা তো বুঝতেই পারছেন। সেজন্য রিফার শিপে সবসময়ই একজন ইঞ্জিনিয়ার থাকতো যে, শুধুমাত্র কার্গো-রেফ্রিজেরেশানের দিকেই খেয়াল রাখতো। জাহাজের ক্রু-রা তাকে ‘ঠান্ডা-সাব’ বলে ডাকতো। ক্রু-রা চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে বলে চীফ-সাব, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার হলো দুই-সাব, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার তিন-সাব, এরকম চার-সাব, ক্যাডেট-সাব, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হলো বাত্তি-সাব।
এই বৃটিশ কোম্পানীর সব জাহাজেই যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশী ক্রু কাজ করতো। আগে কোম্পানীর নাম ছিলো ক্ল্যান লাইন (Clan Line); পরে বদলে হয়েছে Cayzer Irvine বা CI Shipping Line। আমি এবং আমার সঙ্গে জয়েন করা আর একজন এই আমরা দুইজনই ছিলাম এই কোম্পানীতে প্রথম বাংলাদেশী অফিসার। আমাদের পেয়ে জাহাজের ক্রুরা সব্বাই খুব খুশী ও গর্বিত ছিলো। এতদিন ধরে বছরের পর বছর তারা বৃটিশ অফিসারদের অধীনে কাজ করেছে, এবারে করবে স্বদেশীয় অফিসারদের অধীনে। আমি সবেমাত্র আমার ক্যাডেট লাইফ শেষ করে, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সেই জাহাজেই প্রথম কাজ করেছি ১৯৮৭-র নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৮৮-র অক্টোবর পর্যন্ত। CI Shipping-এর সব জাহাজই ছিলো রিফার শিপ কারণ রেফ্রিজেরেটেড কার্গো বহনে পয়সা বেশী।
সেই সময়ে আমরা পোর্টে গেলে হাতে অনেক সময় পেতাম, এবং সেখানে নেমে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। যেহেতু মিস্ট্রাল কন্টেইনার জাহাজ ছিলো না, এবং আমাদের কার্গো লোডিং বা ডিসচার্জিং-এ প্রচুর সময় লাগতো, তাই আমাদের শোর-লিভ (shore leave) ছিলোঅফুরন্ত। ব্রাজিলের প্যারানাগুয়ায় তো পনের-বিশদিন মিনিমাম; মাঝে মাঝে মাসও কাবার হয়ে যেত। আবার পোর্টের পালা শেষ করে যখন রওনা দিতাম, তখন সমুদ্রের মাঝে টানা বাইশদিন থাকতে হতো। সেখানে তখন আরেক ধরনের ধরাবাঁধা রুটিন চলে আসতো। যেসমস্ত জাহাজে একদিন-দুইদিন অন্তর ঘন ঘন পোর্ট আসে, সেগুলোতে রুটিন বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
মিস্ট্রাল জাহাজে জয়েন করাটাও আমার জন্য একটা কাকতালীয় ব্যাপার হয়েছিলো। দুই ঘন্টার নোটিসে বাসা ছেড়েছিলাম সৌদি আরবের জন্য। আমি তখন মেরিন একাডেমিতে Phase-৩ কোর্স শেষ করছি। ভাগ্যক্রমে আমি সেই সময়ে সদ্য-প্রচলিত ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার সার্টিফিকেটও করে ফেলেছিলাম। আমার অন্যান্য বন্ধুরাও পাশ করেছিলো, কিন্তু অন্য কয়েকটা ছোটখাটো কোর্স না করার কারনে সার্টিফিকেট হাতে পাই নাই।
সেসময়ে হঠাৎ করে খবর এলো জেম্স্ ফিন্ডলে থেকে বৃটিশ জাহাজের জন্য অফিসার খোঁজা হচ্ছে। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সেখানে গেলাম। আমার সব কাগজ-পত্র দেখে মুহূর্তেই ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সিলেক্ট করে ফেললো, এবং হাতে প্লেনের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বললো যে, দুপুর তিনটার ফ্লাইটে ঢাকা গিয়ে, পরদিন দুপুরের ফ্লাইটে জেদ্দা। পড়িমরি দৌড়ে বাসায় এসে, স্যুটকেসে সব কাপড় ছুড়ে মেরে, আব্বা-আম্মাকে সালাম করেই স্কুটার একটা ধরে নিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। ঢাকা পৌঁছে সন্ধ্যায় ভাইয়ের সঙ্গে পিজি-তে দেখা করলাম, উনি তখন সেখানে M.Phil. করছিলেন। রাতে এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন জেদ্দায়। অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝে দৌড়েই চলেছিলাম তখন। জেদ্দায় আমার হোটেলে সেজখালু এসে বাসায় একবেলার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপরে সন্ধ্যায় সেই যে এই জাহাজে উঠলাম সেই থেকেই আত্মীয়-স্বজন ছাড়া, বন্দরে বন্দরে ঘুরেছি এগারোটা মাস।
কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সেবার। ঝড়-ঝঞ্ঝা তো আমাদের জন্য নর্মাল ব্যাপার। কিন্তু আমরা ইরান-ইরাক যুদ্ধে পড়েছিলাম। সমুদ্রে এবং বন্দরে ঈদ করেছিলাম। এছাড়া বিভিন্ন বন্দরের নিজস্ব অভিজ্ঞতা তো আছেই- এরকম আরও অনেককিছুই। পরবর্তীতে সেগুলো লিখে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। ইন্টারনেট থেকে মিস্ট্রালের একটা পুরানো ছবি পেলাম, সেটা শেয়ার করছি আপনাদের সাথে। আমার একটা অনুরোধ কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতূহল থাকে, তাহলে নিচের মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com