(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমরা জানি নদীকে কেন্দ্র করেই পেশা, জীবিকা, উৎসব, যাতায়াত-পরিবহণ, বাণিজ্য-বিপণন কেন্দ্র তথা, শহর-বন্দর-নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুগে যুগে দেশে দেশে। হালদাকে কেন্দ্র করে ও জেলে (স্থানীয় ভাষায় ঢোম- মাছ শিকারী, সংগ্রাহক), মাঝি – মাল্লা, পারাপার-পরিবহন, ডিম সংগ্রহ, পোনা/রেণু উৎপাদক, বিক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতা স্থানীয় ভাষায় ‘বাইশবেয়ারী’ ( বাইশ অর্থ মাছের রেণু/ পোনা, বেয়ারী অর্থ বিপণনকারী/ব্যাপারী), নৌকা সাম্পান জাল তৈরীর কারিগর, বাঁশের ব্যবসা, বাঁশ থেকে উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবসা, হালদার পানি নির্ভর কৃষি: ধান, শাকসবজি, বিভিন্ন রকমের ডাল, ভোজনবিলাসীদের পছন্দের হাটহাজারীর মিষ্টি মরিচ, মৌসুমী ফল, ফসল ইত্যাকার কর্মে হালদা পাড়ের লাখ লাখ নিম্নবিত্ত ও সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত ও নির্ভরশীল। এত কিছুর কেন্দ্রে হালদা – সচল বহমান স্বাভাবিক ও স্বকীয় বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের হালদা মুমূর্ষ বা মরা হালদা নয় কিন্তু। যেখানে হালদার পানি দিয়ে ওয়াসা নগরবাসীর দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণে গলদঘর্ম এবং তাতেই হালদা ঝুঁকির মুখে এমনিতর অবস্থায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে হালদার পানি নেওয়ার মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে নদী-পানি- পরিবেশ প্রকৃতি প্রেমী মানুষ মাত্রেই উদ্বিগ্ন। মন্ত্রী বর্ণিত স্টাডিটি হচ্ছে বেজা’র সাথে আইডব্লিউএম (ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) এর চুক্তি মূলে সম্পাদিত “ Water Demand & Water Availability Assessment For Bangabandhu Shekh Mujib Shilpa Nagar (BSMSN)” এই স্টাডিতে প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের বিভিন্ন তথ্য না থাকার এবং সমীক্ষায় অংশীজনদের মতামত না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, “ আইডব্লিউএম আমাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়নি। অনেক পুরানো তথ্য দিয়ে তারা প্রতিবেদন করেছে। শুষ্ক মৌসুমে এমনিতে নদীতে পানি কমে যায় আরও নিলে কি থাকবে? হালদা অন্য দশটি নদীর মতো নয়। লিখিতভাবে আমরা মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে জানাবো” (বিডি নিউজ 24.com) । হালদার অংশীজনদের এই উদ্বেগকে প্রশমিত করা তথা অযৌক্তিক অভিধা দিয়ে হালদার পানি নেওয়ার সিদ্ধান্ত জায়েজ করার জন্যই বর্ণিত স্টাডির (সমীক্ষা) দোহাই। কোন কোন স্টাডিতে ও থাকে নানা হিসেব নিকেশ। নিয়োগকারী কৃর্তপক্ষের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য গোজামিলও দেয়া হয় অনেক ক্ষেত্রে।
১৩.১০.২০২০ তারিখে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের হালদা সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরীতে পানি সরবরাহের জন্য প্রস্তাবিত মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেইজ -২) এর Environmental Impact Assessment (EIA) বিষয়ক যে প্রেজেন্টেশন প্রদান করেন তাতে উপস্থিত অংশীজনরা বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী, ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন. ড. মো: মনজুরুল কিবরীয়া প্রমুখ বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য উপাত্ত ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে যৌক্তিকভাবেই হালদা থেকে পানি নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৩০ জানুয়ারি ২০২১ হালদা পাড়ে ‘হালদা নদী বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক আলোচনা সভা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় কাপ্তাই বাঁধের ২টি স্পিলের পানি সবসময় পাওয়া সাপেক্ষে হালদা থেকে পানি নেয়া যায় বলে অভিমত দেওয়া হয়।এ যুক্তি খোঁড়া, দুর্বল এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ.কে.এম. ফজলুল্লাহ কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন, সরকারের সিদ্ধান্তে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাঁর কাজ করবেন বলে কয়েকটি তথ্যের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন ।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করে এ প্রবন্ধকারের বক্তব্য ছিল আমি প্রাণী বিজ্ঞানী কিংবা পানি বিশেষজ্ঞ নই। সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে হালদা থেকে পানি নেয়া নিয়ে যে দ্বিমত ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়েছে এটা খুবই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। কথা আছে ‘নানা মুনীর নানা মত’ প্রফেসর ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া কিংবা আইডব্লিউএম’র উপনির্বাহী পরিচালক এস.এম.মাহাবুবুর রহমান ভিন্ন অবস্থান ও দৃষ্টিকোণ থেকেই বিষয়টি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করেছেন। জ্ঞান কান্ডের চর্চ্চার ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই, সুতরাং মত-দ্বিমত কিংবা নতুন মত পথের সন্ধান লাভ করাটাই জ্ঞান চর্চ্চা ও গবেষণার উদ্দেশ্য। রাজনীতি বিজ্ঞানে একটা কথা আছে ‘ টহরঃু রহ ফরাবৎংরঃু্থ ু ভিন্নমতের মাঝেই ঐক্যমত্য/সহমত। আমি মনে করি সেই নতুন মত কিংবা পথটা আমরা পেয়েছি তা হচ্ছে শিল্প নগরীতে পানি লাগবে তবে তা হালদা থেকে নয় ভিন্ন উৎস থেকে। কারণ শিল্প নগরী আমরা গড়ছি-গড়ব কিন্তু প্রকৃতির দান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র একটা হালদা আমরা গড়তে পারব না। কাজেই হালদা কে রক্ষা করেই ভিন্ন উৎস থেকে পানি জোগাড় করতে হবে এতে হালদা ও রক্ষা পাবে শিল্পায়ন ও হবে। সভার সভাপতি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার আমার বক্তব্যটাকে শিল্পনগরের পানি সমস্যার সমাধানে গঠনমূলক ও ইতিবাচক পরামর্শ বলে মন্তব্য করেন।
কথা আছে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হলে তা পানির জন্যই হবে। পানি নিয়ে রাজনীতি, কুটনীতি তো আছেই। উজানের দেশের সাথে ভাটির দেশের সম্পর্কেও টানাপোড়ন সদা সর্বদা, এক্ষেত্রেও হালদাবাসীর সাথে সরকারের নীতি নির্ধারকদের।
মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরের জন্য পানির বিকল্প উৎস সমূহ :
১) নিকটস্থ সমুদ্রের পানি Desalination লবণাক্ততা মুক্ত করে ব্যবহার করা যায়। সৌদি আবর, ইসরাইল সহ অনেকেই তা করছে।
২) ফেনী নদী, কালীদহ নদী, সিলোনিয়া নদী, মুহুরী প্রজেক্ট, মহামায়া লেক থেকে পানি নেয়া যায়।
৩) নিকট অতীতে আদমজীতে আমরা বড় বড় দিঘী দেখেছি সে রকম দিঘী খনন করা যায়। উপরন্তু এ শিল্প নগরে ৩.৫ কি.মি একটি জলাধার ভরাট করে ফেলা হয়েছে বলে জানা যায়।
৪) নাপিত ছড়া, খইয়া ছড়া, ঝরঝরিয়া ছড়া, বাওয়া ছড়া, সোনাই ছড়াসহ প্রকৃতিগতভাবে ৩০ হাজার একরের পাহাড়ী ঢালু এলাকা রয়েছে শিল্পাঞ্চলের অদূরে সেখানে বাঁধ দিয়ে জলাধার সৃষ্টি করা যায় এবং বৃষ্টির পানিসহ যাবতীয় পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। আমরা জানি তাইওয়ানের পানির সিংহভাগই হচ্ছে Rain water Harvesting বা প্রকৃতিগতভাবে প্রাপ্ত পানি।
১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বানানো হচ্ছে, আরো বানানো যাবে কিন্তু হালদা বানানো যাবে না – প্রকৃতিগতভাবেই গড়ে উঠেছে। অতএব হালদাকে ঝুঁকিতে ফেলা উচিত হবে না, হালদাকে রক্ষা করাটাই হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি। আবারো ভাবা উচিত, বিকল্প খোঁজাটাই উত্তম যেমনটি হালদা পাড়ের আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জনাব কবির বিন আনোয়ার বলেছেন, “ জনকল্যাণের জন্য দেশের উন্নয়ন প্রয়োজন। হালদা রক্ষা করে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। হালদা নদীর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে রয়েছে” (আজাদী, ৩১ জানুয়ারি ২০২১)। আমরা ‘হালদা নদী বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও বিজ্ঞ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক : সমাজ বিজ্ঞানী ও সিনেট সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান ঘাসফুল।












