মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ৫ মার্চ, ২০২৪ at ৮:২৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী মায়ানমার। এক সময়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই দেশ খনিজ সম্পদে ভরপুর। ৭০৮০ বছর আগে পাক ভারত উপমহাদেশের অনেকে কর্মসংস্থানের জন্য রেঙ্গুনে গমন করতো। এই বিষয় নিয়ে তখন অনেক চলচিত্রও নির্মিত হয়েছিলো। কিন্তু গণমানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের বদলে দীর্ঘ ৬২ বছর যাবত সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও অযাচিত খবরদারির ফলে এই সম্পদশালী দেশটি আজ গৃহযুদ্ধে নিপাতিত। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সীমান্তবর্তী প্রদেশে সামরিক সরকারের লড়াই এখন তুঙ্গে। বেশ কিছু দিন ধরে এই সংঘাতের উত্তাপ বাংলাদেশেও লাগছে। আরাকান আর্মির সাথে তীব্র সংঘাত হচ্ছে মিয়ানমার সৈন্যদের। এতে মায়ানমারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য, সেনা সদস্য, কাস্টমস ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে আছে। তবে মিয়ানমার সীমান্তে যারা বসবাস করছেন তাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ছে গোলা ও মর্টার সেল। রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছে খোদ মিয়ানমার সরকার।

হাজার বছর ধরে মিয়ানমারকে শাসন করেছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী। দেশটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা ১২৪ বছর। শুরুতে বার্মাকে ভারতের একটি প্রদেশ ধরা হতো। পরে ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশরা বার্মা প্রদেশটিকে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা করে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বেরিয়ে আসার পর বার্মা প্রথম বারের মতো স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে মাঝে তিন বছর ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মা জাপানিদের দখলে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বার্মায় জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। তবে বার্মার স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন আগে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা অং সান সংখ্যালঘু অবার্মার জাতিগোষ্ঠীগুলোর সক্রিয় সমর্থন চেয়েছিলো। বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, স্বাধীনতা লাভের পর তাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার এবং কেউ চাইলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারবে। তখন এ সমর্থন আদায়ে শান রাজ্যের একজন রাজকুমার তাঁকে সহায়তা দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার আট মাস আগে অং সান তাঁর কয়েকজন কাউন্সিল সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরবর্তীতে স্বাধীন বার্মার সরকারগুলো প্রতিশ্রুত স্বায়ত্তশাসন দিতে অস্বীকার করে।এ কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৫ বছর ধরে বিভিন্ন বিদ্রোহী পক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে।

১৯৬২ সাল থেকে দেশটি শাসন করছে সামরিক জান্তা এবং তারা সামরিক শক্তি ব্যবহার করে এই বিদ্রোহী তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। মাঝেমধ্যে তারা এক বা একাধিক পক্ষের সঙ্গে অস্ত্র সংবরণ চুক্তি করলেও আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে এমন সশস্ত্র সংঘাত মিয়ানমারের রাষ্ট্র জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশে পরিণত হয়। তবে সামরিক জান্তার নিরবচ্ছিন্ন মানবাধিকার বিরোধী কার্যকলাপের কারণে মিয়ানমার অনেকটা একঘরে হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমকে সন্তুষ্ট করতে এক সময় জান্তা একটি মেকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে রাজি হয়। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দৃশ্যত ক্ষমতায় আসেন অং সান সু চি এবং তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। কিন্তু ক্ষমতার নাটাই থেকে যায় সেনাবাহিনীর হাতে। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এনএলডি বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলে সেনা নায়কেরা তাঁদের ক্ষমতা হুমকির সম্মুখীন বিবেচনা করে এবং ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ফল বাতিল করে পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এতে দেশজুড়ে জান্তা বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হলে তা কঠোর হাতে মোকাবিলা করা হয় এবং সহস্রাধিক তরুণ প্রাণ হারান। এ পর্যায়ে তরুণদের একাংশ জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং শুরু হয় মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, যা তিন বছর ধরে চলছে।২০২১ সালের এপ্রিলে এনএলডির নেতৃত্বে নির্বাচিত সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) গঠন করে, তাতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এনইউজি ঘোষণা করে, সামরিক জান্তাকে পরাজিত করে দেশে একটি ‘ফেডারেল ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন’ গঠন করা হবে এবং সেই লক্ষ্যে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ গঠিত হয়।প্রায় এক ডজন বিদ্রোহী পক্ষ, যাদের সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারা এই প্রয়াসে যোগ দেয়। তবে আরাকান আর্মি ঐতিহ্যগত ভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে।কিন্তু সামপ্রতিক কালে তাদের কিছু বক্তব্যে আরাকান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আছে। আরাকান ও আরাকানে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আরাকান আর্মি মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক জান্তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে।কিন্তু এবারের গৃহযুদ্ধের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। চরম অসন্তোষ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজরা কখনো সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেননি। যুদ্ধে সাফল্য পাচ্ছে প্রধানত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ গোষ্ঠীভিত্তিক দলগুলোই কিন্তু বার্মার তরুণদের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো এ লড়াই অনেকটা জনযুদ্ধের রূপ নিয়েছে।তা ছাড়া এই প্রথম জান্তাকে সারা দেশে সশস্ত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

সমপ্রতি দেশের উত্তরপূর্ব অংশে চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী বেশ কটি সেনাচৌকি বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে।কয়েকটি শহর তারা ছিনিয়ে নিয়েছে সেনাদের কাছ থেকে এবং কিছু সংখ্যক সেনাসদস্য আত্মসমর্পণ করেছে বিদ্রোহীদের কাছে।প্রশ্ন হলো বিদ্রোহীদের বিজয় অর্জনের মাধ্যমে কি ভেঙে যাবে মিয়ানমার? রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জান্তা নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সুয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, চীনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, সরকার যদি তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তাহলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে।

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ একদিন শেষ হবে, তবে দেশটি তখন পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। হয়ত সামরিক জান্তার পরিপূর্ণ পরাজয়ের মাধ্যমে দেশটি ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বার্মার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাবতী অববাহিকা থাকবে মিয়ানমার বা বার্মা হিসেবে।আর অন্যান্য জাতিসত্তা ভিত্তিক সাতটি ‘রাজ্য’ প্রতিটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অথবা একটি প্রকৃত ফেডারেল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার জন গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ভিত্তিক রাজ্যগুলো তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বায়ত্ত শাসন অর্জন করবে। তবে প্রথমটির সম্ভাবনা কম,কারন আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক যে দেশগুলো এখানে তৎপর,এক্ষেত্রে তাদের চাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আঞ্চলিক বাস্তবতায় মিয়ানমারের মূলধারার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও দেশ বিভাজনে এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজতর হবে। কিন্তু মিয়ানমার ভেঙে অনেকগুলো রাষ্ট্রের উদ্ভব বৃহৎ প্রতিবেশী চীন বা ভারত কারোই কাম্য হবে না। ভারত চাইবে না তাদের উত্তরপূর্বের অস্থির সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর পাশে এমন একটি নজির সৃষ্টি হোক। অন্যদিকে চীনের জন্যও তাদের যে বৃহত্তর স্বার্থ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশপথসে লক্ষ্যে একক মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা অনেক বেশি সুবিধা জনক। বস্তুত মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সীমান্ত পুরোটাই কাচিন ও শান রাজ্যের সঙ্গে। আবার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাখাইন রাজ্য মূল মিয়ানমার পার হয়ে। এভাবে তিনচারটি রাষ্ট্র পেরিয়ে এই সংযোগ বজায় রাখা চীনের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। জান্তার ঘনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও চীন বিদ্রোহী পক্ষগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ানও মিয়ানমারের অখণ্ডতাই চাইবে বলে ধরে নেওয়া যায়। সু চির দল এনএলডি বা তাদের নেতৃত্বে বর্তমান জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) অবশ্যই চাইবে মিয়ানমারের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে। এ ছাড়া সামপ্রতিক বিপত্তি সত্ত্বেও জান্তার সেনাবাহিনী শিগগিরই পরাজিত হবেএমনটি মনে করাও ঠিক হবে না।

কিন্তু মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পরাজয় ছাড়া পরিবর্তন আসবে না। হয়ত কোনো একপর্যায়ে, যখন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজ্য থেকে তারা পরাজয়ের মুখে সরে যেতে বাধ্য হবে বা জান্তার সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অনীহা দেখা দেবে, তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা কারও মধ্যস্থতায় দুই পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসবে।

আর তখন জান্তার শীর্ষ নেতৃত্বে কিছু পরিবর্তন ঘটাও অসম্ভব নয়। তাই যদি হয়, তাহলে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীঅধ্যুষিত রাজ্যগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে মিয়ানমারে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ৭৫ বছর ধরে দেশটি জুড়ে যে আঞ্চলিক বিদ্রোহ চলছে, তার মূল লক্ষ্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। আর একমাত্র স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার মধ্য দিয়েই নিষ্পত্তি হতে পারে এই দীর্ঘ সংঘাতের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রজন্মের আলোকবর্তিকা ড. মইনুদ্দীন আহমদ খান
পরবর্তী নিবন্ধদশ কারণে শিশু বুকের দুধ পান করতে চায় না