আপনার সন্তান আপনারই সম্পদ। সম্পদের অযত্ন করতে নেই। পরিচর্যা দিয়ে তাকে সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ করতে হয়। আর তার সর্ব প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব আপনার। গাছ–পালা সহজেই বেড়ে উঠে। পশু–পাখি আপনা আপনি বড় হয়। কিন্তু মানব শিশু মানুষ করা তেমন সহজ কাজ নয়। মানব শিশু শূন্যজ্ঞান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আপনার দেখানো পথেই আপনার সন্তান পৃথিবীকে চিনতে শিখে। জন্মেই সে কান্নার মধ্য দিয়ে জানায় সে ক্ষুধার্ত। আপনি তাকে বুকে তুলে নেন। সে আপনার পরম যত্নে বেড়ে উঠে। ক্ষুধা পেলে সে আপনার কাছে ছুটে আসে। ব্যথা পেলেও, এমনকি খুশি হলেও আপনারই কাছে ছুটে আসে। তার এই আস্থা, নির্ভরতাকে মূল্যায়ন করা আপনারই কর্তব্য। অনেক সময় আমরা দেখি বাচ্চারা মিথ্যে বলে, অনেক কিছুই বাবা মার কাছে গোপন করে। কেউ কেউ বাড়ির ছোট–খাটো কোনও কাজ করতেও অনীহা প্রকাশ করে। তাদের বিশেষ প্রয়োজনের কথা, সমস্যার কথা লুকিয়ে রাখে।একটু ভাবুন! কেন?
আপনি হয়তো বলবেন– ‘আগে এমন ছিলো না। যত বড় হচ্ছে তত বাঁদর হচ্ছে’। আমি বলবো নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করলেন আপনি। সে মিথ্যে বলে, বাধ্য হয়েছে তাই। সে অনেক কিছুই করতে অনীহা প্রকাশ করে নিরুৎসাহিত হয়ে। সে নিজের প্রয়োজনের কথা, সমস্যার কথা লুকিয়ে রাখে, আপনার ওপর আস্থা হারিয়েছে তাই। কোথায়? কখন? কীভাবে হারালেন আস্থা? একটু ভাবুন!
কারণে অকারণে বকাঝকা না দিয়ে যে কোনও পরিস্থিতিতে সত্য বলার পরামর্শ দিন। ভুল হলেও সত্য বলার জন্য তাকে ক্ষমা করে দিন। দেখবেন সে মিথ্যের আশ্রয় নেবে না।
আপনার সন্তানকে ফার্স্ট হতেই হবে, এ+ পেতেই হবে আপনার এমন মনোবাসনা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অবান্তর। মেধা স্রষ্টা প্রদত্ত। মেধার ঘাটতি কোনও দোষ নয়, দুর্বলতামাত্র। পরিচর্যা দিয়ে যা পূরণ করা যায়। আপনার সন্তানকে পাঠাভ্যাসে সহযোগিতা করুন। স্কুলের এ্যাসাইনমেন্ট, ডায়েরির পড়া ভালোভাবে আয়ত্ত করতে সাহায্য করুন। বাকিটা সে ক্লাসেই শিক্ষক ও বন্ধুদের সহযোগিতায় সামলে নিবে। সামান্য পারগতার জন্য অসামান্য উৎসাহ দিন। দেখবেন তার মনের জোর বাড়বে। আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
সন্তানের আনন্দ কিংবা দুঃখ প্রকাশের অনুভূতিগুলোকে মূল্যায়ন করুন। অনেক সময় দেখবেন আপনার সন্তান ব্যথা পেলে বা অসুস্থ হলে কেঁদে বা গুঙিয়ে আপনার সান্নিধ্য বা মনোযোগ আশা করে। তখন ‘চুপ কর। এত ঢং কেন করছো? অনেক বড় হয়েছো’। এ জাতীয় কথা না বলে অন্য কারো সাহস বা ধৈর্যের কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দিন। পারলে ‘আহা রে! উফ্ রে! বলে কাছে টেনে নিন। সমব্যথি হোন। সে যেন বিশ্বাস করে, আজীবন তার যে কোনও সমস্যায় বা বিপদে আপনিই তার পাশে আছেন।
তার ছোটো ছোটো আনন্দে ভাগ বসান, প্রাণ খুলে হাসুন। সে আপনাকেই বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করবে। অনেক সময় অনেক অভিভাবক অতি আদর, অতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে সন্তানের বড় অনিষ্ঠ করে থাকেন। সন্তানের চাহিদা মত খেলনা বা পছন্দের যা কিছু, তা সে যত দামই হোক না কেন কিনে দিয়ে নিজেকে আদর্শ অভিভাবক ভেবে তৃপ্তি পান। আপনার এমন চিন্তা যথার্থ নয়। আপনার ভুল প্রশ্রয় আপনার সন্তানের সুসম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দিতে পারে।
প্রায় দিনই ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময় আমি দেখি অনেক গার্ডিয়ান অন্যকোনও বাচ্চার ডায়রী বা বই থেকে কপি করছেন। ভেবে দেখুনতো, আপনার সন্তানকে কীভাবে দিনে দিনে দায়িত্বহীন হতে সাহায্য করছেন। তাকে নিজের ক্লাসের ডায়েরি বা শ্রেণি অভীক্ষা যা কিছু হোক নিজের দায়িত্বে করার ব্যপারে মনোযোগী করে তুলুন। প্রতিশ্রুতি দিন ডায়েরি লিখে আনলে বা ক্লাসের পাঠ ঠিকভাবে বুঝে নিলে তাকে পুরস্কৃত করবেন। ওয়াদা রক্ষা করুন। দেখবেন একদিনে কাজ না হলেও একমাসে হতে পারে। তবু চেষ্টা করুন। সুঅভ্যাস গড়ে উঠতে সময় কিছুটা বেশি লাগলেও এই সময় বিফলে যায় না।
অনেক সময় শিক্ষক বাড়িতে আসে আবার অনেক সময় ছাত্র শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে পড়ে। যদি কখনো শিক্ষক কঠোর হন অনেক অভিভাবক রেগে যান। ছাত্রের সামনেই শিক্ষকের সমালোচনা করেন। অনেক সময় সন্তানের অভিযোগে ঘন ঘন শিক্ষক বদল করেন। ভেবে দেখুন আপনার এবং শিক্ষকের লক্ষ ভিন্ন নয়। শিক্ষককে সহযোগিতা করুন। সন্তানের দুর্বলতাগুলো শিক্ষকের কাছে তুলে ধরুন। সন্তানকে শিক্ষকের অনুগত করতে না পারলে সেই ব্যর্থতার দায় একদিন আপনাকেই পোহাতে হবে। সে পরবর্তীতে আপনার অবাধ্য হবে। গুরুজনে অভক্তি করবে।
আপনার সন্তান জীবনের প্রথম অনেকটা পথ আপনার সাথেই ভ্রমণ করে। তাই প্রাথমিক সময়ে আপনি যদি তাকে সঠিক শিক্ষা না দেন তবে তার কৃত ভুলের জন্য কি দোষারোপ করতে বা শাস্তি দিতে পারবেন? সন্তানের বয়স যখন দশ থেকে ষোল এর মধ্যে তখন বেশি সতর্ক থাকুন। এ সময়ে তাদেরকে ধর্মীয় বিষয়ে সচেতন করতে হবে যা তাদের চরিত্র গঠনে ও পরবর্তীতে যেকোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে রাখতে সহযোগিতা করবে। এসময় তাদের অনেক বদভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। স্কুলে হাই সেকশনে মাঝে মাঝে স্টুডেন্টরা অভিযোগ করে ব্যাগ থেকে টাকা চুরি হয়েছে। টিফিন কে যেন খেয়ে ফেলেছে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নোট বা বই কেউ সরিয়ে নিয়েছে। অভিযোগগুলো মিথ্যে নয়। অনেক ভালো পরিবারের ভালো সন্তানটি এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। সততা বিষয়ক গুণাবলীর শিক্ষা তাই ছোটো বেলাতেই দিতে হবে।
শিশুরা পৃথিবীর সব কিছুকে নিজের মনে করতে পারে। তাই তাকে ছোটোবেলাতেই শিক্ষা দিন কোন জিনিসটা তার, কোনটি ভাইয়ের, কোনটি বাবার। ফলে নিজের জিনিসগুলোর প্রতি তার আন্তরিকতা ও অধিকার যেমন বাড়বে তেমনি অন্যের জিনিস সম্পর্কে সে সচেতন হবে। অনুমতি ছাড়া তখন কারো জিনিস ধরবে না। পাশাপাশি ও যেন স্বার্থপর না হয়ে উঠে তার জন্য শিক্ষা দিন পরিবারের কোন কোন জিনিস সবাই মিলে ব্যবহার করাই শ্রেয়। এর সাথে সাথে আপনার সন্তানকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলতে দিন এবং বাড়ির ছোটো ছোটো কাজে তার মতামত নিন, আপনাকে সাহায্য করতে উৎসাহিত করুন। তবেই সে আত্মবিশ্বাসী হবে, পরিশ্রমী হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে দিন, দেখবেন সে পড়ার সময় অপচয় করবে না।
উঠতি বয়সে সন্তানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা পিতা–মাতার কর্তব্য। তারা নিজেকে বয়ঃপ্রাপ্ত মনে করলেও আপনার সাহায্য ও সুচিন্তিত উপদেশ সর্বক্ষণ তাদের প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখবেন বিব্রতকর ইল–ফিটিং বা অশোভন পোশাক পরে তারা যেন অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণের আশা পোষণ না করে। তাদের এমন আচরণ সংশোধনে সতর্ক হোন। শালীন পোশাক পরিধানে ও সুস্থ চিন্তার চর্চায় সচেতন করে তুলুন।
প্রথমেই নিজেকে সংযত রাখুন। বাড়িতে অতিথি এলে মুখ গোমরা না করে আনন্দিত হোন। প্রতিবেশী ও গৃহপরিচারিকার সাথে সমঝোতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বজায় রাখুন। আপনার সন্তান আপনাকেই অনুসরণ করবে। দেখবেন আপনার ভদ্র আচরণ, খোলামেলা পারিবারিক সম্পর্ক ও সন্তানদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আপনার সন্তানকে গড়ে তুলবে আপনারই অমূল্য সম্পদ রূপে।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন-‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দেবো’। যথার্থই বলেছিলেন। কেননা, প্রকৃতিই নির্ধারণ করেছে মা–ই সন্তানদের প্রথম শিক্ষক। তাই মা‘ই পারে সন্তানকে প্রাথমিক সব শিক্ষা দিতে। শিক্ষা কেবল বইয়ের পাতার বিষয় নয়। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক অনেক বিষয়ে শিক্ষা মাকেই দিতে হয়। মা হওয়া তাই সহজ কথা নয়।
লেখক : গল্পকার, কবি, শিক্ষক