মায়ার ব্যাবচ্ছেদ

জুয়েল বড়ুয়া বাপ্পু | শুক্রবার , ৪ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

মায়াইন্দ্রজাল, বিভ্রান্তিমোহ! মৃগহরিণ। ইন্দ্রজালের হরিণ। রূপক আবরণের মায়ামৃগ। মনের মর্মে আবাস করা মর্মস্থলের এক অলীক আবেগ। অদৃশ্য অর্স্পৃশ্য এক বস্তু। অদ্ভুত স্নিগ্ধ এক ছোঁয়া। যে ছোঁয়াকে পাওয়া মনে হয়! কবিগুরু রবি ঠাকুরের উক্তিতে– “পাওয়া কাকে বলে মানুষ জানে না। সে ছোঁয়াকেই পাওয়া মনে করে।” মায়ামৃগ উপন্যাসেও খুঁজে পেয়েছি সেই চিত্রপট। উপন্যাসে “প্রেম” এই শ্বাশত শব্দটাই পুরো উপন্যাসের নিউক্লিয়াস। কিছু খোঁজা। পাওয়া না পাওয়ার ভ্রম। প্রার্থনাগুলোর জল হয়ে ওঠা। যেন স্বপ্নের চোখে ঘুমহীন রাত নিয়ে ফিরে যাচ্ছে কেউ

এই উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায় বেশ কিছু চরিত্রের আমিত্ব দর্শন যেন দ্বিখন্ডিত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু চরিত্রে কেবল নিজেকে চেনার প্রয়াস। নিজেকে খোঁজা। চোখে চোখ রেখে বিশ্বাস খুঁজছে। আবার সেই চোখের গভীরে যেন চেনা বিশ্বাসগুলো ডুবে যাচ্ছে। ক্রোধ,শঠতা,অধিকার সবকিছু দিয়ে প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব বিশ্বাসটুকু কেবল চেনার চেষ্টা।

নন্দিনী উপন্যাসের মূল চরিত্র। নন্দিনী কি চেয়েছিলো? প্রেম! যে প্রেম প্রশান্ত,স্থির, চিরন্তন। যে প্রেম বয়ে দিবে স্বপ্নের চোখে দেবদারু বাতাস। নন্দিনী চরিত্রটির গভীরে ঢুকতে চেষ্টা করছিলাম। চেষ্টা করছিলাম লেখক নন্দিনী সৃষ্ট চরিত্রটির মাধ্যমে কি বার্তাটি দিতে চাচ্ছে। উপন্যাসে দেখলাম নন্দিনী স্থির ভালোবাসা খুঁজছে আবার অসাবধানে সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। এখানে পাঠক হিসেবে আমি দ্বিধান্বিত হয়েছি। অথবা এভাবেও বলা যায় লেখক পাঠককে দ্বিধান্বিত করতে পেরেছে। রাশেদ, পাভেল, সাইফ উপন্যাসের অপর তিনটি চরিত্র। এই তিনটি চরিত্রের মধ্যে নন্দিনীর চরণ পথের পথ হবে কে? নন্দিনী কোন পথে বকুল ফুল কুড়াবে! নাকি অমোঘ নিয়তি ঘুম পাড়ানি গানের মতো সবার কানে কানে শুনিয়ে যাবে হেলাল হাফিজের দুইটি লাইন– “এক বুক সুখ নিয়ে ঘুমিয়ে গেলে নাকি? আমি বরাবরই তোমার থেকে আলাদা। এক বুক দুঃখ নিয়ে সারারাত জেগে থাকি।” এই কৌতূহলটা উপন্যাসের অনেকটা জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছেন লেখক।

উপন্যাসের একটা সময় পদ্মা নদীর ঢেউ শোনা যায়। পদ্ম পাড়ের নারীটিও এসে জলের শব্দ ছড়িয়ে দিয়ে যায় কোন এক নিমকষ্টের বনে। নন্দিনীর জন্য বুক পকেটে রেখে দেওয়া গোপন সুখ আর অস্পষ্ট হাহাকার জমিয়ে রাখা উপন্যাসের চরিত্রটিকে দেখা যায় পদ্মপাড়ের নারীটির সাথে জোৎস্নায় নন্দিনীকে না বলা কথাগুলো নিয়ে -“ইচ্ছে ছিলো বিরহের সাথে একরাত কাটাবো নিদ্রায় যার কাছে ঋণী হয়ে শিখেছি নির্ঘুম রাতের সুখ তার সাথেই একরাত পাশাপাশি কাটাবো গভীর ঘুমে।”

আবার উপন্যাসে পদ্ম পাড়ের নারীটিকে প্রথম চুম্বনের স্মৃতি দেওয়া চরিত্রটি গোপনে বুক পকেটে বয়ে বেড়ায় একটি চিরকুট। পদ্মাপাড়ের নারী কি নন্দিনী! নাকি অন্য কেউ? পাঠকরা কেবল “মায়ামৃগ” পড়তে পড়তে পাবে এই ব্যাকুলতার সন্ধান।

মানুষ তো রোজ মরছে। প্রতি মুহুর্তে মরছে পদে পদে। স্বপ্ন মরছে, আশা মরছে, ভাবনা মরছে, মরছে বন্ধুতা, মরছে কত খুঁটিনাটি। শুধু মরছে। এত মরার মাঝেও সব আছে আবার নেই। একজন নয়, কেউই কি মনের সম্পূর্ণতা বুঝতে সক্ষম?

লেখক “মায়ামৃগ” উপন্যাসে যে সময়কাল কিংবা প্রতিটা মুখ্য চরিত্রের বয়সটাকে উপজীব্য করেছে সেই আলোকে এই অস্থিরতাটুকু সমর্থনযোগ্য। তরুণ বয়সের অস্থিরতা। ভাবনার সীমাবদ্ধতায় নিজস্ব পৃথিবীটাকে ছোট করে দেখা। নিরাশায় নিমজ্জিত হয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়া। এই অস্থিরতার প্রক্ষালনে লেখক পাঠকদের কাছে একটি প্রশ্ন রেখে গেছেন সরলরেখায় জীবনের চাকা না চললেই কি জীবনের গতিপথ থামিয়ে দিতে হবে? উপন্যাসে দেখা যায় সমাজের একটা চিরন্তন সত্য নিয়ে লেখক স্পষ্টভাবেই পাঠকদেরকে বোধের আয়নার সামনে মুখোমুখি দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়েছেন। নিজস্ব চিন্তা চেতনা আর বিশ্বাসটুকু অপরজনের মতামতের প্রতি শ্রদ্বা না রেখে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার একটা অসুস্থ বোধ আমাদের চারপাশে লক্ষ করলে বুঝা যায়। লেখক উপন্যাসে এরকম একটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন।

রাশেদ, পাভেল নাকি সাইফ কার ভালোবাসা ছিলো পবিত্র! কে হতে পেরেছিলো নন্দিনীর জন্য দেবদূত! ওরা কি খুঁজেছিলো? বন্ধুত্ব কিংবা আত্নার সম্পর্কটুকু মাড়িয়ে কে কোথায় পৌঁছতে চেয়েছিলো? কেনবা লেখক নন্দিনীকে শুদ্ধ করতে চেয়েছিলো! নাকি সম্পর্কের সবটুকুই ছিলো ভ্রম আর মরিচীকা!

এই তৃষ্ণাটুকু লেখক উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মায়ার ব্যাবচ্ছেদের গল্প নিয়েই এই মায়ামৃগ। পড়তে পড়তে একজন পাঠক নিজের অস্তিত্বের মাঝে এই মায়ামৃগটি আবিষ্কার করতে পারবেন। আর কেউ কেউ হয়তো নন্দিনীতে ডুবে গিয়ে পড়ার শেষে আনমনে বলে উঠবেন কবিতার এই কয়টি লাইন।

আমি হয়তো নাও থাকতে পারি

আর একটা দিন

দেখার জন্য আবার তোমায় চাঁদ,

লক্ষ করি তোমার অপরূপ পূর্ণ দীপ্তি

আহ!

কত সুন্দর এই আমার অন্তিম শ্বাস।”

সবশেষে এসে এই কথাটি বলতে হচ্ছে, সাধারণ অর্থে উপন্যাস বলতে গদ্যে লিখিত দীর্ঘ উপস্থাপনাকে বোঝায়। ছোটগল্পের তুলনায় উপন্যাসের বিস্তৃতি বেশি। উপন্যাস রচনায় ব্যাক্তিচেতনা ও সমাজচেতনা অপরিহার্য। একটি সার্থক উপন্যাসে কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র, বর্ণনাভঙ্গি, রস, সংলাপ,ভাষা ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত লেখকের জীবনদর্শন ও জীবনাভূতিই প্রকাশ পায়। উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিতে সমগ্র মানবজীবন ও সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। এই তথ্যের আলোকে “মায়ামৃগ” হয়তো পুরোপুরি সার্থক উপন্যাসের সারিতে ফেলা যাবে না। তবে কিছুটা চৈতন্যমূলক উপন্যাস বলা যেতে পারে। এই ধরনের উপন্যাসে লেখক মানুষের ব্যক্তিচৈতন্যের গভীরে নিমজ্জিত নানা বিষয়ের আংশিক আভাস দিয়ে থাকেন।

সর্বোপরি “মায়ামৃগ” উপন্যাসটির চরিত্রগুলো যেন আমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। লেখক কেবল সেখান থেকে ঘটনাগুলোকে অর্থাৎ আমাদের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবিগুলোকে শব্দের প্রাণে প্রাণ সঞ্চারিত করে দিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাঞ্চননগরে হবে টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট
পরবর্তী নিবন্ধঅনুপম সেন : সাম্যবাদ উত্থানপ্রত্যাশী স্বাপ্নিক