সেন্ট্রাল বার্মার মান্দালে হল শুষ্ক অঞ্চল। নাতিশীতোষ্ণ দেশের মানুষ হয়ে শুষ্ক প্রকৃতি-পরিবেশ কেমন হয় সেটি এখানে এসেই প্রথম দেখলাম। আমাদের ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার ঝানু মানুষ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে যেতে যেতে আমাদের বিভিন্ন গল্প করতে লাগলো। আমরা যাচ্ছি এই শুষ্ক অঞ্চলের মরুদ্যান হিসেবে পরিচিত পোপা পর্বতের একটি অংশের উপরে অবস্থিত নাতদের মন্দির এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রম দেখতে। মরুদ্যান বলার কারণ হল, এই শুষ্ক অঞ্চলের মাঝে পোপা পর্বত এলাকাতে আছে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ২০০টি পাহাড়ি ঝরনা এবং জলপ্রপাত। এই পর্বত মূলত একটি মরে যাওয়া আগ্নেয়গিরি। গবেষক এবং তাসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খীন শউ- এর গবেষণা থেকে জানা যায় আজ থেকে প্রায় ৮০০০ হাজার বছর আগে এই আগ্নেয়গিরি হতে শেষ অগ্নুৎপাত হয় এবং এর লাভা গিয়ে মেশে ইরাবতী নদীতে। অনেকে বলেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৪২ সালে শেষ অগ্নুৎপাত হয়েছে, কিন্তু গবেষকেরা এখনও তার কোন প্রমাণ পায়নি। আগ্নেয়গিরির লাভা স্তর জমা হবার কারণে পোপা পর্বত এলাকা অতি উর্বর এবং প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। এই পর্বত বেশ কয়েকটি নাত এর আবাসভূমি। নাত নিয়ে আগেও বলেছি। আবার আরেকটু বলি। নাত হল সেইসব আত্মা যাতের দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। মানুষ মারা যাবার পর তাঁর জীবদ্দশায় কৃতকর্ম এবং আধ্যাত্মিক সাধনার উপর নির্ভর করে একজন মানুষের আত্মা নাত হিসেবে গণ্য হয়। বার্মায় এই বিশ্বাস ছিল মূলত বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং প্রসারের আগে। এই অঞ্চলের প্রকৃতি পূজারি (এনিমিস্ট) মানুষেরা নাতদের পূজা করত। এখন পর্যন্ত ৩৭ নাতের কথা জানা যায়, বার্মার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়েছিটিয়ে এরা বাস করে বলে প্রচলিত বিশ্বাস। বার্মার মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও, নাতদেরও তারা পূজা করে। এখানে প্রকৃতিপূজা এবং বুদ্ধের দর্শন মিলেমিশে গেছে। একজন ভ্রমণকারী লিখেছেন, পরিবারের পাপ মোচনের জন্য বার্মার সব পরিবারের প্রত্যেক প্রজন্ম থেকে অন্তত একজন ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করে, মানে ঘর-সংসার ছেড়ে বুদ্ধের দেখানো পথে হাঁটেন। কিন্তু, সে তো দর্শন আর আধ্যাত্মিক কথা। কিন্তু, প্রাত্যহিক জীবনে স্থানীয় মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন তারা নাতদেরই পূজা করে এবং স্মরণ করে। বাগানের বৌদ্ধ প্যাগোডা কিংবা রেঙ্গুনের প্যাগোডার দেয়ালের গায়ে নাতদের প্রতিমূর্তি খোদাই করা বা আঁকা আছে। এই দুই ধারার মিলনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল বার্মার জাতির পিতা বলে পরিচিত রাজা আনাওরাথা।
আমরা প্রধানত যেই চূড়ায় যাব তার নাম টুয়াং তালাত, এর চূড়ায় চারজন নাত বাস করে বলে স্থানীয় বিশ্বাস। গাড়ির চালক বলছিল বছরে দুইবার ডিসেম্বরের শেষে এবং এপ্রিলে নববর্ষের সময় এখানে তীর্থযাত্রার অনুষ্ঠান হয়, যেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। তীর্থযাত্রীরা প্রায় দশ মাইল দূরের পর্বতের পাদদেশ থেকে হেঁটে এসে চূড়ায় উঠে। টুয়াং তালাতের কাছাকাছি এসে আমাদের গাড়ি থামাল। কাছাকাছি মানেও কয়েক মাইল দূরে। গাড়ির চালকের দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে আমরা হাঁটা শুরু করলাম স্থানীয়দের পিছু পিছু। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বাস দাঁড়ানো। স্কুল কলেজে পড়ার বয়সী ছেলেমেয়েরা এসেছে দলেদলে। কথা বলে জানা গেল সবাই এসেছে নাত মন্দির দর্শনে। আমি আর মিকাও মিশে গেলাম তীর্থযাত্রীদের সাথে। কিছুক্ষণ পরপরই বৌদ্ধ জাদি, প্যাগোডা। এই মাউন্ট পোপাকে তুলনা করা হয় গ্রিক পুরাণের অলিম্পাস পর্বতের সাথে, যেখানে গ্রিক দেব-দেবীদের বসবাস ছিল। মাইলখানেক হাঁটার পর একটা জায়গায় এসে আমরা মূল সড়ক থেকে বায়ে ঢালু সরু সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নামছি তো নামছি, কিন্তু এই নামার যেন শেষ হচ্ছে না। এই সিঁড়ি আবার এঁকেবেঁকে গেছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে। কোন কোন জায়গায় সিঁড়ির দুই পাশে দোকান সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। সিঁড়ি ধরে নেমে আমরা এলাম আরেকটি সড়কে। সেখানে আবার খুব জমজমাট মেলা বসেছে। আমরা মেলার ভেতর দিয়ে এগিয়ে টুয়াং তালাতের মন্দিরের উঠার সিঁড়ির গোড়ায় এসে পৌঁছালাম। খালি পায়ে উঠতে হবে এই সিঁড়ি ধরে। এই টুয়াং তালাত হল পোপা পর্বতের একটি চূড়া যেটি সমুদ্রস্তর থেকে ৬৬০ মিটার লম্বা। এটিকে আগ্নেয়গিরির ঘাড় বলা হয়। সোজাকথায় আমি বুঝি, সেই হাজার হাজার বছর আগে যে আগ্নুৎপাত হয়েছিল তার ফলে এই পর্বত নামি বিশাল পাথরের স্তূপ মাথা গজিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পাদদেশ থেকে চূড়ায় উঠতে হবে ৭৭৭টি সিঁড়ি বেয়ে। সরু সিঁড়ি ধরে আমরা উঠতে থাকি। আমাদের সাথে উঠছে নান সাজের হরেক রকমের মানুষ। গাড়ি থেকে নাম অবধি এখন পর্যন্ত দেখলাম ছেলেরা এখানে মেয়েদের বেশ উত্যক্ত করে। মেয়েরাও দেখি খুব একটা গা করে না কেউ। আবার কেউ কেউ খুনসুটিতে যোগ দেয়। আমাদের সাথে দু-একজন খুব ভাব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু আমি গায়েপড়া ব্যাপারটা নিতেই পারি না। মিকাকেও বলে দিলাম এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। এক জায়গায় আমাদের সামনে বেশ স্বাস্থ্যবান নাদুসনুদুস একটি পরিবার পড়ে গেল। সরু সিঁড়ি ধরে একজন করেই উঠতে হবে, আমি আর মিকা হেলেদুলে ওদের পেছনে পেছনে উঠতে থাকলাম। এক জায়গায় সিঁড়ি এতই সরু আর খাঁড়া যে বুক দুরুদুরু করতে লাগলো। হাতের স্যান্ডেলকে ব্যাগের পেছনে বেঁধে নিলাম। আমার এক-আধটু এমন খাঁড়া পথ বেয়ে উঠার অভিজ্ঞতা থাকলেও মিকার এবারই প্রথম। কোন কোন জায়গায় ওকে টেনে তুললাম, আবার কোন কোন জায়গায় মিকা আমাকে টেনে তুলল। আমার উচ্চতা ভয়ের কারণে যত উপরের দিকে উঠছি পায়ে এক ধরনের মাথায় শিরশির অনুভূতি হতে লাগলো আর মাথায় ঘুরঘুর করছিল যদি গড়িয়ে পড়ি তাহলে কি হবে। আবার পাহাড়ে চড়ার প্রস্তাব আমার, তাই আমার এই ভয়ের কথা বলা যাবে না। এইসব ভাবতে ভাবতে দম ফুরিয়ে যাবার আগে আমরা পার করে এলাম প্রায় সব সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে বাম থেকে ডানে পাড় হতে হবে সরু একটা লোহার সাঁকোর মত জিনিসের উপর দিয়ে। স্থানীয় ছেলেরা মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মানুষকে সাহায্য করছে পার হবার সময়। উপরে উঠে প্রথমেই আমরা দেখা পেলাম বানরের দলের। একটা বানরকে দেখলাম কোকের ক্যান থেকে কোক খেতে। চূড়া থেকে বহুদুর পর্যন্ত বিস্তৃত বনভূমি দেখা যায়। এই বনেই কয়েক বছর আগে রেকর্ড করা হয় নতুন এক ধরনের লম্বা লেজের বানরের, নাম দেয়া হয় পোপা লেঙ্গুর। এরা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছ কেননা মাত্র ২০০-এর মত বানর এখানে বর্তমানে টিকে আছে। তবে মন্দিরের উপরের বানর আবার সে জাতির না, এরা এক্কেবারেই আমাদের চিরচেনা ম্যাকাউ বানর।
বানরের সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করে মন্দির দেখা শুরু করলাম। আগেই বলেছি এখানে চারজন নাতের বাস। মন্দিরের পিলারগুলো কারুকার্য খচিত। মন্দিরের একটি কক্ষে তিনজন নাতের প্রতিমা- একজন মা আর তার দুই ছেলে। কথিত আছে এই মা ছিল মে ইউন্না নামের এক রাক্ষসী যে ছিল পোপা মেদাউ, মানে এই পোপা পর্বতের রাজকীয় মা। তিনি কেবল ফুল খেয়ে বেঁচে থাকত। পাগান রাজ্যের একাদশ শতকে রাজা এবং বার্মিজ জাতির পিতা আনাওরাথা একবার আদেশ দিলেন প্রতিদিন পোপা পর্বতের সব ফুল তুলে বুদ্ধের পূজায় দিতে হবে। এ-কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিল ব্যায়াত্তা নামে রাজার বাগানের এক কর্মচারীকে। মে ইউন্না প্রেমে পড়ে গেলেন ব্যায়াত্তার। তাদের দুটি ছেলেসন্তান হল। কিন্তু রাজা এই সম্পর্ক মানতে রাজি হলেন না। রাজার আদেশ অমান্য করার দায়ে ব্যায়াত্তাকে মেরে ফেলা হল। আর মৃত্যুর পর ব্যায়াত্তা হয়ে গেল একজন নাত। তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে যাওয়া হল প্রাসাদে। প্রেমিক এবং সন্তানের শোকে মে ইউন্না রাক্ষসীর বুক ভেঙে গেল এবং মারা গেল। মারা যারাও পর মে ইউন্না হয়ে গেল একজন নাত। তখন থেকে ব্যায়াত্তা এবং মে ইউন্না নাত হিসেবে এই চূড়াতেই বাস করা শুরু করে। পরবর্তীতে মান্দালে শহরের কাছের একটি প্যাগোডা নির্মাণকাজে অবহেলার দায় দিয়ে মেরে ফেলা হয় তাদের দুই ছেলেকেও। দুই ছেলেও মৃত্যুর পর হয়ে যায় নাত। নাত হয়ে তারা আর পোপা পর্বতে ফিরে আসেনি। তারা রয়ে যায় মান্দালের কাছের সেই মন্দিরে। এখন প্রতি বছর তাদের উৎসর্গ করে পূজা আর উৎসব হয় সেই মন্দিরে।
(চলবে)
rupsbd@gmail.com