মবের দৌরাত্ম্য কমছে না। যে কেউ মবের শিকার হচ্ছে। কেউ হচ্ছে নাজেহাল, কেউ অপদস্ত আবার কেউ লাঞ্ছিত। কোনও প্রতিকার নেই, সবাই যেন নির্বিকার। কারো যেন কিছুু করার নেই। শুধু অপমান আর লাঞ্ছনা নয় কেউ কেউ মবের হাতে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। কেউ বলে মবতন্ত্র, কেউ বলে মবকালচার আবার কেউ কেউ বলে মবজাস্টিস। আসলে মবভায়োলেন্স। জাস্টিস বা বিচারের জন্য আইন আদালত আছে। গ্রামে সালিশের মাধ্যমেও ছোট খাট বিচার আচার হয়ে থাকে। কিন্তু জোর জবরদস্তি জুতার মালা পরিয়ে দেয়ার নাম বিচার না, অবিচার। এটা বড় ধরনের অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিবেকবান কেউ এ ধরনের অপরাধকে সমর্থন করতে পারে না। নিশ্চুপ না থেকে সবার এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এ অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকবে, বেরিয়ে আসা যাবে না। সবকিছু এর ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকবে। মবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
পিতা মাতার পর শিক্ষকের স্থান। শিক্ষক ছাড়া সন্তানেরা শিক্ষিত হতে পারে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। বাবা–মা বড় করে তুললেও শিক্ষকরাই জ্ঞানের পথ দেখায়। আলোর পথে নিয়ে যায়। এজন্য অনেকের কাছে শিক্ষক পিতৃতুল্য। আবার অনেকের কাছে তার চেয়েও বেশি। সন্তানেরা একটু বড় হলে অনেক সময় মা–বাবার সাথে মতের মিল হয় না। অনেকে অবাধ্যও হয়ে যায়। পিতা মাতাকে আর সেভাবে মান্য করে না। কিন্তু শিক্ষকদেরকে সবসময় সম্মান করে, শ্রদ্ধার চোখে দেখে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর কাছে সর্বদা শ্রদ্ধার পাত্র। তবে বিগত সময়ে কিছু কিছু শিক্ষার্থীর মাঝে মবের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তারা শিক্ষকদেরকে নানাভাবে নাজেহাল করতে থাকে। স্কুল কলেজ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা অপমানিত হতে থাকে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান প্রধানেরা মবের শিকার হয় বেশি। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ব্যাহত হয়। অনেক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও কলেজের প্রিন্সিপালকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে শিক্ষাঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করতে থাকে। যা কোনোভাবে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার জন্য সহায়ক নয়।
চুির চামারির ঘটনা সমাজে বহুকাল থেকে। রাস্তায় ছিনতাই অহরহ ঘটে। তেমন একটা বিচার হয় না। এদের কেউ ধরতেও পারে না। কোথাও আবার ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। গণপিটুনির শিকার হয়। গ্রামে ছোটখাট চুরির দায়ে অনেক সময় বড় শাস্তি পেতে হয়। বিশেষ করে দরিদ্র শিশুরা কিছু চুরি করলে তাকে বেঁধে মারধর করে। তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। অমানবিক নির্যাতন। প্রতিকারে কেউ এগিয়ে আসে না। এমন মনোভাব চুরির শাস্তি পেতে হয়। এ বয়সে চুরি করেছে, বড় হলে কী করবে? অথচ বেশিরভাগ চোরের কোনও শাস্তি হয় না। এরা চুরি করে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ এদের খুঁেজ পায় না। কখনো ধরলেও আবার ছাড়া পেয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথাযথ না থাকলে চুরি ছিনতাই বেড়ে যায়। সমাজের অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। আবার অপরাধীর শাস্তি না হলেও অপরাধ বেড়ে যায়। এমনও হয় পুলিশের কাছে সোপার্দ করার পরও অপরাধীর বিচার হয় না। তখন মানুুষ চোর ছিনতাইকারী ধরতে পারলে পিটাতে শুরু করে। অনেক সময় গণপিটুনিতে অপরাধীর মৃত্যুও হয়ে যায়। আবার এমন ঘটনাও ঘটে নিরাপদ কেউ গণপিটুনির শিকার হয়ে যায়। এখানেও এক ধরনের মব প্রবণতা কাজ করে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়।
কেউ কেউ বলে মবকালচার অনেক পুরানো। এ মবোক্রেচি বহুকাল থেকে চলমান। জোর জবরদস্তি বল প্রয়োগ কোন সময়ে ছিল না। সব সময় শক্তিশালীরা নিরীহের ওপর জোর খাটিয়েছে। অর্থাৎ এক সময়ে বলা হতো ‘জোর যার মুল্লুক তার’। এখনো প্রবাদটা চালু আছে। জোরের কাছে পেশি শক্তির কাছে কিছুই টিকে না। কিন্তু কথা হলো মব যারা করে তারা কি এতই শক্তিশালী? সাত আটজন মিলে যখন একজনের ওপর চড়াও হয়, তখন সে এমনিতে কাবু হয়ে যায়। এসময় যদি কেউ এগিয়ে না আসে তখন যা ইচ্ছা তা করতে থাকে। তারা আবার কোন না কোন পরিচয়ে মবের সাথে যুক্ত হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায়। ফলে সাধারণ মানুষ আর এগিয়ে আসে না। কখন আবার নিজেরাই মবের শিকার হয়ে যেতে পারে এ ভয়ে থাকে। তারা এমন কিছু বিষয়কে ইস্যু বানিয়ে মবের অবতারণা করে সেখানে সাধারণ কেউ যেতে চায় না। বিষয়গুলো এমনি ধরনের কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও অপমানিত করা হয়, অপদস্ত করা হয়। ফলে মব যেখানে হয় সেখানে কেউ যেতে চায় না। এজন্য যেখানে সেখানে মগের মুল্লুকের মতো মব চলতে থাকে।
একসময়ে হঠাৎ করে তারা মাজার ভাঙতে শুরু করে। মাজারের প্রতি এদেশের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভক্তি রয়েছে। এ উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার হয়েছে সুফি সাধকের মাধ্যমে। ফলে মাজার ভাঙাকে কেউ সহজভাবে নেয়নি। এরপর তারা বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ি ভাংচুর করে। অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়। হামলা ভাংচুর লুটপাট একের পর এক চলতে থাকে। তাদের আর কেউ থামাতে পারে না। অবশ্য প্রথম দিকে অনেক থানা মবের শিকার হয়। থানার অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, পুলিশকে মারধর এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটে। অনেকে বলতে থাকে পুলিশের প্রতি জনগণের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
শহরে বন্দরে অফিসে আদালতে নগরীর সবখানে মব চলে। গ্রামে গঞ্জে এমনকি পাড়ায় মহল্লায় মব চলে। দেশের সর্বত্র যেন মবের রাজত্ব। অথচ জনসাধারণ কখনো মব চায় না। তারপরও মবতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়। স্বৈরতন্ত্র একনায়কতন্ত্র এসবের বিরুদ্ধে মানুষ স্বোচ্চার কিন্তু মবতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেভাবে সোচ্চার হতে পারছে না। তার অন্যতম কারণ মবতন্ত্রের সাথে রাজনীতির পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা। তার সাথে প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা। তার চেয়েও বড় কারণ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি–যাকে বলে চরম অবনতি। আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে মবতন্ত্র এভাবে মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। যখন তখন যেখানে সেখানে মানুষ মবের শিকার হতে পারে না। মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। মবতন্ত্রের মতো আইন বহির্ভূত নিপীড়নমূলক অপরাধ তৎপরতাকে কেউ সমর্থন করতে পারে না।
বড় ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের পর বা গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটলে আইন শৃংখলার অবনতি ঘটে। এমনকি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। তখন মবতন্ত্র প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওদের দৌরাত্ম্য সীমাহীনভাবে বেড়ে যায়। যেহেতু তাদের বাধা দেয়ার বা নিয়ন্ত্রণ করার কেউ থাকে না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর মাসের পর মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও মবের দৌরাত্ম্য কোথাও কমেনি। প্রায় এক বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলছে অথচ আইন শৃংঙ্খলা বাহিনী দেখেও না দেখার মতো আছে। তাদের নাকের ডগায় মবের উৎপাতে মানুষ অতিষ্ঠ। তারপরও মবকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। মব সৃষ্টিকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।