সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ‘সংকট থেকে সেবা: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সংলাপ ও পদক্ষেপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বেসরকারি খাতকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা দেশে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে এ আহ্বান জানান, যাতে সবার জন্য সেবা নিশ্চিত হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও ১৭ কোটির অধিক জনসংখ্যার এই দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা তেমন গুরুত্ব পায় না, যেখানে ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সাজেদা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাহিদা ফিজ্জা কবির বলেন, দুর্যোগের পরেই কেবল মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবা উচিত নয়। বিষয়টিকে দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত করা দরকার, যাতে প্রয়োজনের সময় যথাযথ সেবা দেওয়া যায়। তিনি মানসিক স্বাস্থ্য খাতে সবার জন্য, বিশেষ করে দুর্যোগের সময়ে মানসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারি ও এনজিওর পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। জাহিদা ফিজ্জা কবির মানসিক স্বাস্থ্য খাতে একটি একক নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং অভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরের (এসওপি) প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এস এম মুস্তাফিজুর রহমান মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সমপ্রসারণের জন্য আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি, বহুপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পায় মানসিক স্বাস্থ্য খাত। এই অর্থের বেশির ভাগই আবার চলে যায় প্রাতিষ্ঠানিক বরাদ্দে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বড় ঘাটতি রয়েছে। এখানে মাত্র ১ হাজার ৫২৫ জন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী আছেন, যাঁদের মধ্যে ২৬০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ৫৬৫ জন মনোবিজ্ঞানী এবং ৭০০ জন নার্স।
উল্লেখ্য, গত ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার উদ্দেশ্যে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য হলো: ‘বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অধিকার’। এই প্রতিপাদ্যটি সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, যে সময় এসে গেছে, জীবনের চরম সংকটকালেও যেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের জীবন সব সময় এক সরল রেখায় চলে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প আবার এইযে বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধ বা সংঘাত চলছে–এই বিষয়গুলোও আমাদের মনে আঘাত করে। বিপর্যয়ের শিকার প্রায় প্রতিটি মানুষই তীব্র মানসিক চাপ, ভয়, উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যায়। প্রিয়জন হারানোর বেদনা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা–এই সবকিছু মিলিয়ে মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই এই সময় ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা, হতাশা বা পোস্ট–ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার –এর মতো রোগে ভুগতে পারেন। অন্যদিকে এই সব পরিস্থিতিতে মানুষের কষ্ট–অসহায়ত্ব, দেখেও আমাদের মনে ক্ষত তৈরি হয়। যারা আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু এই সময়েই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে আসে, প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে। তাঁরা বলেন, বিপর্যয় বা জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকারের মতোই মানবিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। এর বাইরেও আরও কিছু প্রস্তুতি আমাদের নিয়ে রাখা উচিত। যেমন সহানুভুতিশীল সমাজ তৈরি করতে হবে। আমাদের চারপাশে যারা বিপর্যয়ের শিকার, তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখানো অত্যন্ত জরুরি। তাদের কথা মন দিয়ে শোনা এবং তাদের পাশে থাকাটাই চিকিৎসার প্রথম ধাপ। এরপর দরকার নেতিবাচক ধারণা দূর করা। ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি যে কোনো রোগের মতোই স্বাভাবিক। মোট কথা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।


