বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আজ। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। ১৯৫০ সালের এই দিনটিকে জাতিসংঘ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে এ দিনটি পালিত হচ্ছে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাদেশে এ দিবস পালিত হচ্ছে। আলোচনা সভা, শোভাযাত্রাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো দেশ বা সমাজকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য বা স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে মানবাধিকারকে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা সহজ এবং কার্যকরও বটে। মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় বুলি আওড়ানো বিশ্বের কথিত ক্ষমতাধর ব্যক্তি–নেতারা এর তোয়াক্কা করছে বলে মনে হচ্ছে না। বিভিন্ন পরিবেশে মানবাধিকার ব্যাখ্যার তারতম্যে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের বিপুল উদাহরণে অধিকাংশক্ষেত্রে সমাজ পর্যুদস্ত। আন্তর্জাতিকভাবে কারা কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে তার স্বরূপ ইতিমধ্যে সর্বত্রই উন্মোচিত। সত্য–বস্তুনিষ্ঠ মানদন্ডে মানবাধিকার বিষয়টি যথাযথ মূল্যায়ন করা না হলে দেশ–জাতি–বিশ্ব প্রকৃত অর্থেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্বের ৩৮টি দেশ মানবাধিকার চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘন করছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশগুলোর নাম তালিকাভুক্ত করেছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের মহাসচিব বার্ষিক প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। এসব দেশ হত্যা, নির্যাতন ও নির্বিচারে গ্রেফতারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দেশগুলো চরমভাবে অধিকার কর্মীদের ওপর বলপ্রয়োগ করে। দেশগুলোকে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। নতুন দমন–পীড়নের ঘটনা লিপিবদ্ধ করার ক্যাটাগরিতে রয়েছে ২৯টি দেশ। আর পুরনো ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকার ক্যাটাগরিতে রয়েছে ১৯ দেশ। দশটি দেশের নাম দুই ক্যাটাগরিতেই রয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নতুন করে ২৯ দেশ মানবাধিকার কর্মীদের ওপর দমন–পীড়নে জড়িত হয়ে পড়েছে। চূড়ান্তভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় যেসব দেশে সেগুলো হলো– বাহরাইন, ক্যামেরুন, চীন, কলম্বিয়া, কিউবা, কঙ্গো, জিবুতি, মিসর, গুয়াতেমালা, গায়ানা, হন্ডুরাস, হাঙ্গেরি, ভারত, ইসরায়েল, কিরগিজস্তান, মালদ্বীপ, মালি, মরক্কো, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, রাশিয়া, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, দক্ষিণ সুদান, থাইল্যান্ড, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান এবং ভেনিজুয়েলা।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। গত ২৯ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেন। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এই তথ্য তুলে ধরেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এ সময় যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন ‘এটি আমাদের জন্য বিশেষ করে মানবাধিকার কর্মীদের জন্য একটি বড় মাইলফলক। ৭০০ জনের ওপরে মানুষ এখন পর্যন্ত গুমের কারণে নিখোঁজ হয়ে আছেন। আর যেন কেউ কখনো নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে কোনো বাহিনীকে দিয়ে কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে নাগরিকদের গুম করতে না পারে। এ জন্য এই সনদে স্বাক্ষর করা হয়েছে। এ বিষয়ে এখন প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার গ্রহণ করা হবে।’
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও জানিয়েছে। এ বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারমূলক বিষয়গুলোর অন্যতম হলো, প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা। এই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (আইসিপিপিইডি)’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কনভেনশনে বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইসিপিপিইডি জাতিসংঘের আওতাধীন একমাত্র আন্তর্জাতিক কনভেনশন যা এনফোর্স ডিসএপিয়ান্সকে কেন্দ্র করে গৃহীত হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম প্রতিরোধ করা, ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এ ছাড়া গুরুতর এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। ৩০ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম দিবস পালনের আগেই উপদেষ্টা পরিষদে বৈঠকে আইসিপিপিইডিতে বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সব মানবাধিকার ও সুশাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। সর্বস্তরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন–২০০৯ প্রণয়ন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়েছে। দেশের সব নাগরিকের বিশেষ করে শিশু ও নারীর মানবাধিকার রক্ষায় সরকারি–বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।