আমরা অনেকেই মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার এর সূক্ষ্ণ পার্থক্য না বুঝে দু‘টাকেই মিশিয়ে ফেলি। সচেতন নাগরিক হিসেবে এ পার্থক্য বুঝা দরকার। বিশেষ করে যারা অধিকার ও সুশাসন কর্মী তাদের বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন। নিম্নে সংক্ষেপে পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হলো। মানবাধিকার হচ্ছে মানুষের কিছু জন্মগত অধিকার এবং যেসব অধিকার থেকে কাউকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এক কথায় মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকা, যথাযথভাবে বেড়ে ওঠা, শিক্ষালাভ করা, রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাপ্য সেবা যথাযথভাবে পাওয়া এগুলোকেই মানবাধিকার বলা হয়।
মানবাধিকারসমূহ অবশ্যই রাষ্ট্র এবং সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে। মানবাধিকারের বিষয়ে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এনে দেশ ও জাতি থেকে তার দৃষ্টি ব্যক্তি মানুষের প্রতি সম্প্রসারিত করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘সকল মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সমান’। এই ঘোষণা পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। সারা বিশ্বের মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য ১০ই ডিসেম্বরকে ‘মানবাধিকার দিবস‘ ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীর সকল মানুষের অধিকার রক্ষায় প্রতি বছর এই দিনে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করা হয়। এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো: বিশ্বব্যাপী সকল মানুষকে মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা।
রাষ্ট্র পরিচালনাকারী বা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমানো। যারা মানুষের অধিকারকে খর্ব করছে, তাদের সতর্ক করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা। মৌলিক অধিকার যখন কতিপয় মানবাধিকার কোনো দেশের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দ্বারা সেসব অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করা হয় তখন সেগুলোকে মৌলিক অধিকার বলা হয়।
মৌলিক অধিকারগুলো সবই মানবাধিকার কিন্তু সব মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণা বা জেনেভা কনভেনশন ঘোষণা:- মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি এবং দাতা সংস্থা কাজ করছে। তারমধ্যে জাতিসংঘ সর্বদাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ অংশে বিশ্বের মানুষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বের মানুষের অধিকার সংরক্ষণের জন্য।
একটি ঘোষণা তৈরি হয়েছিল, সেই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল জাতি–ধর্ম–বর্ণ–ভাষা–নারী–পুরুষ–শিশু নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদানে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা। ১৯৪৮ সালের এই ঘোষণা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা বা জেনেভা কনভেনশন হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘের সার্বজনীন ঘোষণায় মানুষের প্রায় সকল প্রকার মানবাধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে।
এই ঘোষণায় ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। বিষয়গুলি নিম্নরূপ :- ১. সমতার অধিকার। ২. বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়ার অধিকার ৩. জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার ৪. দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার ৫. নির্যাতন ও অবমূল্যায়ন থেকে মুক্তির অধিকার আইনের চোখে একজন ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার ৭. আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এই অধিকার পাওয়া ৮. উপযুক্ত আদালত থেকে বিচার পাওয়ার অধিকার। ৯. বে–আইনী আটক ও বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভের অধিকার ১০. নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য শুনানীর অধিকার। ১১. অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ ব্যক্তির মত আচরণ পাওয়ার অধিকার। ১২. পরিবার, বাড়িতে এবং পত্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার। ১৩. স্বাধীনভাবে যে কোনো দেশে যাওয়া ও আসার অধিকার। ১৪. অমানবিক যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার অধিকার ১৫. জাতীয়তা পাওয়া এবং পরিবর্তন করার অধিকার।
১৬. বিয়ে করা এবং পরিবার গঠন করার অধিকার। ১৭. সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার। ১৮. নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্মের স্বাধীনতা। ১৯. মতামত দেওয়া ও তথ্য পাওয়ার স্বাধীনতা। ২০. শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও সংগঠন করার অধিকার ২১. মুক্ত নির্বাচন ও সরকারের অংশগ্রহণের অধিকার ২২. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। ২৩. কাঙ্ক্ষিত কাজ পাওয়া ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ২৪. অবসর ও বিশ্রাম পাওয়ার অধিকার ২৫. স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন–যাত্রার অধিকার ২৬. শিক্ষার অধিকার। ২৭. সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার ২৮. মানবাধিকার রক্ষাকল্পে সামাজিক নিশ্চয়তার অধিকার ২৯. মানবাধিকার রক্ষাকল্পে সমাজের কর্তব্য পালন ৩০. উপরোক্ত অধিকারগুলোর ব্যাপারে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার। মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সম্পর্কে অবহিত থাকা প্রত্যেক সুনাগরিকের মানবিক দায়িত্ব।
এসব ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের সাথে সহয়োগিতা করে আপন আপন এলাকায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারেন। বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার:- নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সকল সচেতন নাগরিক হিসাবে নৈতিক দায়িত্ব। এ অংশে প্রভাবশালী নেতাদের সাথে সংক্ষিপ্ত আকারে এ দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তৎকালীন গণপরিষদের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকরী হয়। এই সংবিধানের ৩য় ভাগে ২৭ থেকে ৪৪ পর্যন্ত মোট ১৮টি অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ১৬টি মৌলিক অধিকার যুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সমূহ নিম্নরূপ:
১. আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী (অনু: ২৭), ২. ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কোনো বৈষম্য করবে না (অনু: ২৮), ৩. কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে (অনু: ২৯), ৪. রাষ্ট্রপতির পূর্ব অনুমতি ব্যতীত কেউ কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নিকট থেকে কোনো উপাধি, সম্মান, পুরস্কার গ্রহণ করতে পারবে না (অনু: ৩০), ৫. আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা কারও প্রতি গ্রহণ করা যাবে না যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে (অনু: ৩১), ৬. আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না (অনু: ৩২), ৭. গ্রেফতারকৃত যে কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে এবং তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শ ও তার মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুয়োগ দিতে হবে (অনু: ৩৩), ৮. জোরপূর্বক কাউকে শ্রমদানে বাধ্য করা যাবে না (অনু: ৩৪), ৯. কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক লাঞ্ছনা দেওয়া যাবে না (অনু: ৩৫), ১০. বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধে চলাফেরা, এর যেকোনও স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে (অনু: ৩৬), ১১. প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলো।
(অনু: ৩৯), ১২. যেকোন আইনগত ও আইনসংগত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে (অনু: ৪০), ১৩. যেকোন ধর্মাবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে (অনু: ৪১), ১৪. প্রত্যেক নাগরিককে সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি ব্যবস্থা করার অধিকার থাকবে (অনু: ৪২), ১৫. স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভ ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার প্রত্যেকের থাকবে (অনু: ৪৩), ১৬. উপরোক্ত অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করার অধিকার প্রত্যেকের থাকবে (অনু: ৪৪), উপরোক্ত মৌলিক অধিকারগুলো স্ব স্ব অবস্থান থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারেন।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।