মাদক সমস্যা তথা মাদক দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার ও অবৈধ পাচার একটি জটিল, বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও চোরাচালান সমস্যা দেশ–কাল, ধর্ম–বর্ণ, সমাজ নির্বিশেষে আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে। ধনী–দরিদ্র, উন্নত–উন্নয়নশীল কোন দেশই মাদক সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। মাদককে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত–দ্বন্দ্ব, কলহ, দুর্ঘটনা, ধ্বংস ও মৃত্যুর যে খেলা চলছে তাকে নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আসছে মাদক, যাচ্ছে মাদক। বলতে গেলে মাদকের ট্রানজিট রুট হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আসছে ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা, যাচ্ছে ইয়াবা ও আইস। উভয় ক্ষেত্রেই চট্টগ্রামকে ব্যবহার করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। কাট–আউট পদ্ধতিতে মাদকের চালান পাচার হওয়ায় ধরা পড়ছে না গডফাদাররা। মিয়ানমার হয়ে টেকনাফ এবং ভারত থেকে বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে আসা মাদক বন্দর নগরী হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। এ অবস্থায় কক্সবাজারের পাশাপাশি চট্টগ্রামকেও মাদকপ্রবণ এলাকা হিসাবে ঘোষণার চিন্তা–ভাবনা করছে সরকার।
কখনো সড়ক, কখনো সমুদ্রপথে মাদক পাচার হচ্ছে চট্টগ্রামে। মাদক বহনের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা কৌশল। ওল কচু থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, এমন কোনো পণ্য নেই যার মাধ্যমে মাদক পাচার হচ্ছে না। আর পেটের ভেতরে করে ইয়াবা পাচার এখন প্রতিদিনের ঘটনা। র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ৫ শতাধিক অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ৪৫ লাখ পিস ইয়াবা, ২০ হাজার বোতল ফেনসিডিল এবং ৭ হাজার কেজি গাঁজা। আর এসব মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছে ৭০০ মাদক বহনকারী।’
জানা যায়, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে উৎপাদিত আফিম দিয়ে চীনকে অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করার প্রতিক্রিয়ায় ১৮৩৯ সালে চীনের সম্রাট মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ব্রিটেনের সঙ্গে চীনের এই যুদ্ধই ইতিহাসে প্রথম আফিম–যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই চীন আধুনিক যুগে প্রবেশ করে এবং উন্নতির পথে যাত্রাও সূচিত হয়। বাংলাদেশেও এখন মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি যুদ্ধ প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে শুরু হয়েছে মাদক বিরোধী অভিযান। এই অভিযানে বিপুল পরিমাণে মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং যানবাহন জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ আছে, একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা এই ব্যবসায় জড়িত। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও কেউ কেউ এসবে জড়িত রয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, পুলিশের ভেতর ইয়াবা ও মানব পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে।
মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদকের বিস্তার রোধের লক্ষ্যে সামাজিক ও পারিবারিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিতে হবে। মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। মাদকের ব্যবহার ও পাচার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, আইনের ফাঁকফোকর বন্ধের বিষয়ে পরিস্কার হতে হবে। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবন থেকে মাদকদ্রব্য উৎখাত এবং মাদকাসক্তি নির্মূল করতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। এর জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা জাগাতে হবে। প্রতিটি পরিবারপ্রধানকে সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। তাছাড়া স্কুল–কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্ক শিক্ষা প্রদান এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যদিও বলেছেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি। অভিযানের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তবে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি না হলে মাদক নির্মূল খুব কঠিন।’ তবু আমরা বলতে চাই, মাদক গ্রহণ ও পাচার বন্ধ করতে হলে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগী হয়েও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। আমাদের এই মুহূর্তে উচিত মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থার পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থান করা।